এই অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় পঞ্চতন্ত্র টীকা । এখানে কবিপরিচয়, রচনাকাল ও গ্রন্থের বিষয়বস্তু আলোচিত হয়েছে। এই গাথা বিষয়ক গ্রন্থটি দ্বাদশশ্রেণীর পাঠ্যসূচীতে গৃহীত হয়েছে। আমরা এখানে সংস্কৃত গল্প সাহিত্যে পঞ্চতন্ত্রের স্থান আলোচনা করো বা পঞ্চতন্ত্র বিষয়ে টীকা লিখ, নিয়ে আলোচনা করব। একদশ, দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এছাড়াও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর , WBSSC(SLST) পরীক্ষার্থীদের পঞ্চতন্ত্র অধ্যয়ন করতে হবে।
সংস্কৃত সাহিত্যে কাব্য, নাটক ইত্যাদির মতো গল্পও এক অত্যন্ত সমৃদ্ধ শাখা। গল্পকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় ‘কথা’। এই কথার ইতিহাস অতি প্রাচীন। ঋগ্বেদে ভেকসুক্তে , ছান্দোগ্য উপনিষদের সারমেয়ের উপাখ্যানে মানবেতর প্রাণী নিয়ে গল্পের সমাবেশ দেখা যায়। মহাভারতেও অনেক গল্প স্থান পেয়েছে, সেখানে এক-একটি নীতির দ্বারা উপদেশ দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, উদ্যোগপর্বে ডিণ্ডিক নামে একটি ইঁদুর ও বিড়ালের গল্পটি উল্লেখযোগ্য। তবে পরবর্তীকালে এই গল্পগুলিই একটি স্বতন্ত্র সাহিত্য-শাখার জন্ম দিয়েছে এবং তার দ্বারা নীতিশিক্ষা দানের উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে। জড়বুদ্ধিসম্পন্ন রাজকুমারদের অর্থশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র প্রভৃতিতে শিক্ষিত করে তোলার জন্যই রাজসভার ব্রাহ্মণ-পন্ডিতেরা পশুপাখি, মানুষ, দৈত্য প্রভৃতিকে অবলম্বন করে গল্প রচনা করতেন। কালক্রমে এভাবেই গল্পসাহিত্যের এক বিশাল ভাণ্ডার গড়ে ওঠে। এই গল্পসাহিত্যে বা কথাসাহিত্যে বৌদ্ধজাতক কাহিনি ও অবদান কাহিনিগুলির প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ।
পঞ্চতন্ত্র
পঞ্চতন্ত্র টীকা বিষয়ে কয়েকটি কথা।
গ্রন্থ | পঞ্চতন্ত্র |
গ্রন্থবিভাগ | গল্প সাহিত্য |
রচয়িতা | বিষ্ণুশর্মা |
তন্ত্র | পাঁচটি |
পাঁচটি তন্ত্র | মিত্রভেদ, ত্রিপ্রাপ্তি, কাকোলুকীয়, লব্ধপ্রণাশ এবং অপরীক্ষিতকারক |
মোট গল্প | 63টি |
ভূমিকা
গল্প শোনার আকর্ষণ মানুষের সহজাত। শিশুমনে তাই তো এত আকুতি গল্প শোনার। গল্প শোনার আকর্ষণ তীব্র হয়েছে গল্প বলার ভঙ্গি থেকে। দুর্বার এই আকর্ষণ ও সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই উদ্ভূত হয়েছে গল্পসাহিত্যের। সংস্কৃত সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য দুটি গল্পগ্রন্থের মধ্যে অন্যতম বিষ্ণুশর্মা রচিত পঞ্চতন্ত্র।
“পঞ্চতন্ত্র” গল্পসাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য সম্পদ। গ্রন্থের রচয়িতা, লব্ধকীর্তি, ব্রাহ্মণ বিষ্ণুশর্মা। তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে এর বেশি আর কিছুই জানা যায় না। পাশ্চাত্য পণ্ডিত অনেকে পঞ্চতন্ত্রটিকে খ্রীষ্টোত্তর যুগের রচনা বলে মনে করলেও হার্টেল-এর মতে পঞ্চতন্ত্রের রচনা কাল দ্বিতীয় শতকের আগে নয়।
রচনার উদ্দেশ্য
দাক্ষিণাত্যে মহিলারোপ্য নগরের রাজা অমরশক্তির অত্যন্ত জড়বুদ্ধিসম্পন্ন তিন পুত্র। রাজপুত্ররা মূর্খ,বেচারা রাজা সেই ছেলেদের শিক্ষাদানের জন্য পন্ডিত বিষ্ণুশর্মার সাহায্যপ্রার্থী হলেন। বিষ্ণুশর্মা গল্পচ্ছলে ছয়মাসে নীতিশিক্ষাক্রমে শিক্ষণের উপকরণ হিসেবে এই গ্রন্থটি রচনা করেন। গল্পগুলি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অজ্ঞিতা প্রসূত। রাজনীতি সম্বলিত ও বৈচিত পূর্ণ। পশু-পক্ষী জন্তু-জানোযারকে দিয়ে লেখক কথা বলিয়েছেন, কাজ করিয়েছেন। তাদের মধ্যে মানুষের চরিত্রের দোষ, গুণ, মূর্খতা, শঠতা, সাধুতা, আত্মত্যাগ প্রভৃতি সুনিপুণভাবে যুক্ত করেছেন।
গ্রন্থ বিভাগ
নির্দিষ্ট পাঁচটি তন্ত্র বা বিভাগ নিয়ে গ্রন্থটি রচিত। বিভাগগুলি হল –
- I) মিত্রভেদ,
- II) মিত্রলাভ,
- III) কাকোলূকীয়,
- IV) লব্ধপ্রনাশ এবং
- V) অপরীক্ষিতকারক
গ্রন্থের শুরুতে গ্রন্থকার স্বয়ং বলেছেন-
“সকলার্থশাস্ত্রসারং জগতি সমালোক্য বিষ্ণুশমেসন।
তন্দ্রৈঃ পঞ্চভিতেচচকার সুমনোহরং শান্ত।”
বিষয়বস্তু
প্রত্যকটি তন্ত্রে মূল গল্পের কাঠামোর মধ্যে ক্রমিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোটো ছোটো গল্প এবং প্রতি গল্পের শেষে নীতিশ্লোকের সমাবেশ এই গ্রন্থের মূল বৈশিষ্ট্য। বিশেষত রাজনীতি শাস্ত্রের জটিল তত্বগুলি সহজ সরল ভাষায় পাঁচটি তন্ত্রের গল্পগুলিতে উপস্থাপিত হয়েছে।
তন্ত্রগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয়
I) মিত্রভেদ :— এই তন্ত্রটিতে মোট ২২টি গল্প আছে। এই তন্ত্রের মূল গল্পটির বিষয়বস্তু হল – দমনক নামে এক ধূর্ত শিয়াল পিঙ্গলক নামে এক সিংহের সঙ্গে সঞ্জীবক নামে এক ষাঁড়ের বন্ধুত্ব করিয়ে দেয়। পরে সে সেই বন্ধুত্ব ভেঙে দেয় এবং কৌশলে পিঙ্গলককে দিয়ে সঞ্জীবককে হত্যা করায়। এ ছাড়া এই তন্ত্রে কাকের বুদ্ধিতে কেউটের বিনাশ, কাঁকড়ার হাতে অতিলোভী বকের বিনাশ, খরগোশের বুদ্ধিতে সিংহের বিনাশ, জীর্ণধন বণিকের কথা, মূর্খ বানরের দ্বারা রাজার বিনাশ প্রভৃতি গল্প রয়েছে। রাজনীতিশাস্ত্রের নানান নীতি, যেমন—সাম, দান, ভেদ ও দণ্ড পদে পদে বিভিন্ন চরিত্রের মুখে বসানো হয়েছে। এ ছাড়া সাধারণ নীতিকথাও গ্রন্থটিতে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।
II) মিত্রলাভ :— মিত্রলাভ শব্দের অর্থ বন্ধুত্বলাভ। লঘুপতনক নামে এক কাকের সঙ্গে হিরণ্যক নামে এক ইঁদুরের বন্ধুত্বলাভের গল্প এই তন্ত্রে স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া, এই তন্ত্রে বণিক সাগরদত্ত ঘর থেকে বিতাড়িত হয়েও কীভাবে স্থির বিশ্বাসে ও ভাগ্যের জোরে আবার অর্থবান হল অথবা সোমিলক নামে এক তাঁতি নিজের চেষ্টা সত্ত্বেও কীভাবে ভাগ্যবিপর্যয়ে সব হারাল, প্রভৃতি নিয়ে মোট 6টি গল্প আছে।
III) কাকোলূকীয় :—কাকোলূকীয় শব্দের অর্থ কাকে ও পেঁচায় অর্থাৎ চিরশত্রুতা। পেচকরাজ অরিমর্দনের সঙ্গে কাকেদের রাজা মেঘবর্ণের চিরশত্রুতা এই তন্ত্রের বিষয়বস্তু। এ ছাড়া, দুষ্টবুদ্ধি ধূর্তেরা কী করে মিত্রশর্মা নামে ব্রাহ্মণকে ঠকিয়ে ছাগল নিয়ে নিল প্রভৃতি মোট 4টি গল্প এখানে আছে। এই তন্ত্রটি সন্ধি ও বিগ্রহ অবলম্বনে রচিত।
IV) লব্ধপ্রনাশ :— লব্ধপ্রণাশ শব্দটির অর্থ পেয়ে হারানো। এই তন্ত্রের মূলগল্পের কাহিনি হল—কীভাবে বিশ্বাসঘাতক কুমির পরমবন্ধু বানরকে পেয়েও হারিয়েছিল। এ ছাড়া এই তন্ত্রে যুধিষ্ঠির নামে এক কুমীরের গল্প, শুদ্ধপট নামে ধোপার গাধাকে বাঘের চামড়া পরানোর গল্প প্রভৃতি মোট 16টি চমৎকার গল্প আছে।
V) অপরীক্ষিতকারক :— অপরীক্ষিতকারক শব্দের অর্থ অবিমৃশ্যকারিতা বা হঠকারিতা। এই তন্ত্রটির মূল কাহিনি এইরকম—শ্রেষ্ঠী মণিভদ্র একদিন রাতে সোনালাভের স্বপ্ন দেখেন। পরদিন সকালে সেই লোভে তিনি এক নাপিত-সন্ন্যাসীকে হত্যা করেন এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। এই তন্ত্রে ব্রাহ্মণ ও নকুলের গল্প, চারটি মূর্খ ব্রাক্ষ্মণ বালকের গল্প, একটি উদর ও দুই মুখবিশিষ্ট ভারঙ পাখির গল্প প্রভৃতি অত্যন্ত বাস্তব ও জীবনোপযোগী বক্তব্য প্রকাশে সমর্থ। এই তন্ত্রে মোট 15টি গল্প আছে। এই তন্ত্রে রাজনীতি, সমাজবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের গল্প আছে।
মূল্যায়ন
এক একটি তন্ত্রে এক একটি প্রধান গল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং এই মূল গল্পের কাঠামোর মধ্যে অসংখ্য ছোটো ছোটো গল্পের সমাবেশ ঘটেছে। গল্পগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি গল্পের মধ্যে অন্য গল্পের অবতারণা করে মূল গল্পকে অব্যাহত রাখা গ্রন্থকারের রচনাকুশলতার পরিচয় বহন করে। গল্পগুলির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এবং রসক্ষুণ্ণতা না করে স্থানে স্থানে শ্লোকের সন্নিবেশ নিপুণ কথাশিল্পীর পরিচয় দান করে। প্রতিটি -গল্পের শেষে নীতিকথাটি সহজ ও সুন্দর হৃদয়গ্রাহী শ্লোকে রচিত। পঞ্চতন্ত্রের ভাষা অত্যন্ত সরল এবং গল্পগুলিও চিত্তাকর্ষক। প্রতিটি চরিত্র লেখনীর সঞ্জীবনী যাদুস্পর্শে অবাস্তবে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অলীক হয়েছে মূর্ত প্রত্যক্ষ। বিষ্ণুশর্মার আর একটি বড়ো কৃতিত্ব এই যে তিনি বস্তুনিরপেক্ষ ভাবগুলিকে পশুপক্ষীর আকার দিয়ে জীবন্ত করে তুলেছেন। বর্ণনা ভঙ্গিটির মধ্যে এমন চমৎকার নাটকীয় চমৎকারিত্ব আছে যে পঞ্চতন্ত্রে কোনো কিছুকেই অবাস্তব মনে হয় না। বর্তমানে প্রচলিত পঞ্চতন্ত্র গ্রন্থটি মূল পঞ্চতন্ত্রের একটি সংস্করণ বিশেষ।
অনুরূপ পাঠ
পঞ্চতন্ত্র টীকা এর মত একইধরণের বিষয় জানতে নিম্নের LINK এ CLICK করুন ।
পঞ্চতন্ত্র থেকে জিজ্ঞাস্য
1) পঞ্চতন্ত্র কার রচনা?
2) পঞ্চতন্ত্র কী জাতীয় রচনা?
3) পঞ্চতন্ত্রে কয়টি তন্ত্র আছে?
4) পঞ্চতন্ত্রে কয়টি গল্প আছে?
ধন্যবাদ
আমাদের www.sanskritruprekha.com সাইট Visit করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সংস্কৃতের আরো অনেক তথ্য পাওয়ার জন্য Home Page আসুন। Home Page পৌঁছানোর জন্য CLICK HERE👈
আমদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে CLICK HERE 👈