এই অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় বেদাঙ্গ । এখানে বেদাঙ্গের বিষয়বস্তু বিস্তারিতভাবে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও স্কুল সার্ভিস কমিশনের WBSSC ( SLST ) সিলেবাস অনুসারে আলোচিত হল।
এই অধ্যায়ে বেদাঙ্গের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হল। অর্থাৎ বেদাঙ্গ কী ? বেদাঙ্গের প্রকারভেদ , বেদাঙ্গকে বেদপুরুষরূপে বর্ণনা প্রভৃতি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করা হয়েছে। এই অধ্যায় খুটিয়ে অনুশীলন করলে বেদাঙ্গ নিয়ে সমস্ত প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যাবে।
বেদাঙ্গ কী
বেদের অঙ্গ, অর্থাৎ বেদ সঠিক ভাবে জানতে হলে বা বুঝতে হলে এই বেদাঙ্গের জ্ঞান অপরিহার্য এবং বাধ্যতামূলক।
বেদাঙ্গ কয়টি
“শিক্ষা কল্পো ব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষম্” অর্থাৎ শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ—এই ছটি বেদাঙ্গ।
বেদাঙ্গ বেদপুরুষের অঙ্গ
বেদাঙ্গগুলি অঙ্গী বেদপুরুষের এক একটি অঙ্গবিশেষ। অঙ্গহীন শরীর যেমন বিকলাঙ্গ, বিকল, বেদাঙ্গের জ্ঞান ব্যতিরেকে বেদপুরুষও তেমনি বিকল, বিকলাঙ্গ। বেদের সংহিতা, ব্রাহ্মণ আরণ্যক ও উপনিষৎ যথারীতি পাঠের, তাদের অর্থবোধের এবং বিনিয়োগের সহায়ক এই ছয় বেদাঙ্গ। অঙ্গী বেদের শব্দবোধ, অর্থবোধ, ক্রিয়ার সঙ্গে মন্ত্রের সম্বন্ধ, পাঠের রীতি, প্রভৃতি ব্যাপারে অপরিহার্য বলেই এদের বেদের অঙ্গ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এক একটি অঙ্গের দ্বারা এক এক প্রকার প্রয়োজন সাধিত হয়।
ছয়টি বেদাঙ্গকে বেদ পুরুষের ছয়টি অঙ্গরূপে পাণিনীয় শিক্ষায় বর্ণনা করা হয়েছে—
“ছন্দঃ পাদৌ তু বেদস্য হস্তৌ কল্পোহথ পঠ্যতে।
জ্যোতিষাময়নং চক্ষুর্নিরুক্তং শ্রোত্রমুচ্যতে।।
শিক্ষা ঘ্রাণং তু বেদস্য মুখং ব্যাকরণং স্মৃতম্।
তস্মাৎ সাঙ্গমধীত্যৈব ব্ৰহ্মলোকে মহীয়তে।।”
অর্থাৎ ছন্দ বেদের পাদদেশ, কল্প বেদের হস্তযুগল, জ্যোতিষ বেদের চক্ষু, নিরুক্ত কর্ণ, শিক্ষা নাসিকা, এবং ব্যাকরণ বেদের মুখ। এই ছয়টি অঙ্গ সহ বেদ অধ্যয়ন করিলে ব্রহ্মলোক প্রাপ্তি ঘটে।
উপনিষদ্ গ্রন্থরাজি প্রকাশের পূর্বেই বেদাঙ্গ প্রকাশিত বা বিরচিত হয়েছিল কারণ উপনিষদে ছয় বেদাঙ্গের নাম দেখা যায়। যেমন প্রসিদ্ধ মুণ্ডকোপনিষদের সূচনাতেই পরা ও অপরা উভয় প্রকার বিদ্যার উল্লেখ করে অপরা বিদ্যার দৃষ্টান্ত প্রসঙ্গে ঋষি চার বেদ ও ছয় বেদাঙ্গের নাম করেছেন।
“তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোহথর্ববেদঃ।
শিক্ষা কল্পো ব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দোজ্যোতিষম্।।”
ঋক্, যজুঃ, সাম, অথর্ব এই চারটি বেদকে এবং শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ এই ছয় বেদাঙ্গকে অপরা বিদ্যা বলেছেন এবং যে বিদ্যা দ্বারা অক্ষর ব্রহ্ম লাভ করা যায় তাকে পরা বিদ্যা বলেছেন। বেদ এবং বেদাঙ্গকে যে অপরা বিদ্যা বলা হয়েছে তা হেয় অর্থে নয়, কেবল শাস্ত্র পাঠ করলেই শাস্ত্রবেদ্য পরমপুরুষকে লাভ করা যায় না; যদি যেত তা হলে প্রত্যেক শাস্ত্র পাঠকারীর ব্রহ্মলাভ হত । ব্রহ্মদর্শন জন্ম আত্মজ্ঞান একান্ত প্রয়োজন । বেদ, বেদাঙ্গ বা শাস্ত্রপাঠ আস্তিক্যবুদ্ধির দৃঢ়তা সম্পাদন করে, ব্রহ্মপ্রাপ্তি করাতে পারে না। এই অর্থে ‘অপরা বিদ্যা’ বলা হয়েছে।
বেদাঙ্গের রচনাকাল
Max Muller-এর মতে 600 – 200 খৃঃ পূর্বাব্দের মধ্যে বেদাঙ্গগুলি রচিত হয়েছিল। Macdonell-এর মতে 500 – 200 খৃঃ পূর্বাব্দই বেদাঙ্গসমূহের রচনাকাল। উপনিষদের যুগেই বেদাঙ্গ রচনা শুরু হয়েছিল এবং কোনো কোনো বেদাঙ্গ তারও পূর্বেই রচিত হয়েছিল বলে মনে হয়। উপনিষদ গ্রন্থে বেদাঙ্গের নাম দৃষ্ট হয়। বেদাঙ্গগুলি সূত্রাকারে নিবদ্ধ; স্বল্পাক্ষর, অসংদিগ্ধ ও বিশ্বতোমুখ— ‘স্বল্পাক্ষরমসংদিগ্ধং সারবদ্ বিশ্বতোমুখম্।’
বেদাঙ্গ – শিক্ষা
ছয় বেদাঙ্গের মধ্যে শিক্ষাকে প্রথমে স্থান দেওয়া হয়েছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে শিক্ষার উল্লেখ আছে। যে শাস্ত্রে বেদের বর্ণ, স্বর, মাত্রা, ইত্যাদির যথাযথ উচ্চারণ ও প্রয়োগবিধি লিপিবদ্ধ আছে, তাহাকে শিক্ষা বলে। ইংরাজিতে শিক্ষাকে phonetics বা ধ্বনি বিজ্ঞান বলা হয়। শিক্ষার বিষয় বর্ণজ্ঞান, উচ্চারণ বিধি অর্থাৎ বিভিন্ন বর্ণের উচ্চারণস্থান নির্ণয়, স্বর, মাত্রা, বল, সাম ও সন্ধান বিষয়ক বা সন্ধি বিষয়ক নিয়মাবলী; হ্রস্ব দীর্ঘ-প্লুত ভেদে স্বরমাত্রার পার্থক্য, উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত স্বরের সঠিক উচ্চারণ প্রভৃতি। মন্ত্রগুলির উচ্চারণ বিঘ্নিত হলে, অর্থও বিঘ্নিত হয়—অনর্থের উৎপত্তি ঘটে। “দুষ্টঃ শব্দঃ স্বরতো বর্ণতো বা মিথ্যাপ্রযুক্তো ন তমর্থমাহ।”
“ঋষিছন্দোদৈবতানি ব্রাহ্মণার্থং স্বরাদ্যপি।
অবিদিত্বা প্রযুঞ্জানো মন্ত্রকণ্টক উচ্যত।।
স্বরো বর্ণোহক্ষরং মাত্রা বিনিয়োগেহর্থ এব চ।
মন্ত্রং জিজ্ঞাসমানেন বেদিতব্যং পদে পদে ।।”
প্রত্যেক বেদের পৃথক পৃথক শিক্ষা গ্রন্থ ছিল। প্রাচীনতম শিক্ষা নামক বেদাঙ্গগুলি প্রতিশাখ্য নামে অভিহিত । ঋগ্বেদের প্রাতিশাখ্য মহর্ষি শৌনক বিরচিত। কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় শাখার তৈত্তিরীয় প্রাতিশাখ্য ; শুক্লযজুর্বেদের বাজসনেয়ী প্রাতিশাখ্য মহর্ষি কাত্যায়ন বিরচিত; অথর্ববেদের প্রাতিশাখ্য বলা হয় শৌনকরচিত। বর্তমানে সমস্ত শিক্ষাগ্রন্থ পাওয়া যায় না । শুক্ল যজুর্বেদের যাজ্ঞাবল্ক্যশিক্ষা, সামবেদের নারদীয় শিক্ষা, অথর্ববেদের মাণ্ডুকীশিক্ষা বর্তমানে পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের শিক্ষাগ্রন্থ অনাবিষ্কৃত। বর্তমানে পাণিনীয় শিক্ষা গ্রন্থটিকেই ঋগ্বেদের শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এটি পরবর্তী কালের রচনা। এছাড়া আপিশলি শিক্ষা, ভারদ্বাজশিক্ষা, বাসিষ্ঠ শিক্ষা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত এবং বেদাঙ্গভুক্ত না হলেও মহর্ষি কাত্যায়ন ও শৌনকরচিত অনুক্রমণীজাতীয় গ্রন্থগুলি এই শ্রেণীর অন্তর্গত।
বেদ | শিক্ষাগ্রন্থ |
ঋগ্বেদ | পাণিনীয় শিক্ষা |
সামবেদ | নারদীয় শিক্ষা |
শুক্ল যজুর্বেদ | যাজ্ঞাবল্ক্য শিক্ষা |
অথর্ববেদ | মাণ্ডুকী শিক্ষা |
বেদাঙ্গ – কল্প
কল্পশাস্ত্রকে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বলে মনে করা হয়। বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে ব্রাহ্মণের সাথে কল্পশাস্ত্রের সাদৃশ্য লক্ষ্য করার মতো। বৈদিক যাগযজ্ঞ প্রণালী কালক্রমে কর্মপ্রধান এবং অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে। উক্ত যজ্ঞ প্রণালী শিক্ষা করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়লে কল্পশাস্ত্রের অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন দেখা দেয়। এজন্য যজ্ঞপ্রণালীর সংক্ষিপ্ত প্রক্রিয়াই কল্পসূত্রের আলোচ্য বিষয়। বিপুলায়তন ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলির বিবিধ আখ্যায়িকা মূলক অংশ এবং কর্মকাণ্ডের বিবরণবাহুল্যকে বর্জন করে শুধু প্রয়োজনীয় বিধি-বিধানকে সূত্রাকারে সংক্ষেপে স্মৃতিতে ধরে রাখাই প্রধান উদ্দেশ্য কল্পসূত্রের । প্রধান প্রধান ব্রাহ্মণগুলিরই কল্পসূত্র। কল্পসূত্রগুলি তিনটি কাণ্ডে বিভক্ত। এগুলি হল—(1) শ্রৌতসূত্র, (2) গৃহ্যসূত্র, (3) ধর্মসূত্র।
ব্রাহ্মণ গ্রন্থে বিহিত ও বিবৃত শ্রৌত যাগের বিধি, নিয়মাদি যে সকল সূত্রে গ্রথিত হয়েছে তাহাদের শ্রৌতসূত্র বলা হয়। হোম, ইষ্টি, পশু ও সোম চতুর্বিধ প্রকৃতি যাগের ও তাহাদের ‘অঙ্গ’ যাগের বিধান শ্রৌতসূত্রে দৃষ্ট হয়। অগ্নিহোত্র, দর্শপূর্ণ-মাস, অশ্বমেধ, ও সর্ববিধ পশুযাগ, জ্যোতিষ্টোম প্রভৃতি যাবতীয় শ্রৌত যাগ এই চারিপ্রকার প্রকৃতিযাগের অন্তর্গত। গৃহস্থের করণীয় সংস্কার ও যাগাদি যাহাতে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ আছে তাহাদের গৃহ্যসূত্র বলে। গৃহস্থের করণীয় পঞ্চমহাযজ্ঞ এবং গর্ভাধান হইতে প্ৰেতকৃত্য অবধি সর্ববিধ সংস্কারের বিধান গৃহসূত্রে নিহিত আছে। ব্রহ্মযজ্ঞ বা বেদ-স্বাধ্যায়, নৃযজ্ঞ বা অতিথিসেবা, দেবযজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ অর্থাৎ শ্রাদ্ধ এবং ভূতযজ্ঞ এই পাঁচটিকে পঞ্চমহাযজ্ঞ বলে। আবার গৃহ্যসূত্রের সমতুল্য তৃতীয় প্রকারের আর এক সূত্রসাহিত্য কল্পসূত্রের অন্তর্ভুক্তরূপে পরিগণিত হয়। তার নাম ধর্মসূত্র । ধর্মসূত্রে ধর্মসম্বন্ধীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয়বিধ বিধিনিষেধাদি লিপিবদ্ধ আছে। চতুর্বর্ণ ও চার আশ্রম সংক্রান্ত বিধি নিয়ম ধর্মসূত্রকারগণ রচনা করে গিয়েছেন। ধর্মসূত্রগুলিকে পরবর্তী কালের স্মৃতিশাস্ত্রের জনক বলা হয়। চারিবেদের যতগুলি শাখা ততগুলিই শ্রৌতসূত্র ও ধর্মসূত্র ছিল। বর্তমানে সবগুলি পাওয়া যায় না।
ঋগ্বেদের দুটি ব্রাহ্মণের দুটি কল্পসূত্রের নাম যথা—আশ্বলায়নকল্পসূত্র ও কৌষীতকি কল্পসূত্র। সামবেদের তিনটি শ্রৌতসূত্র, মাশক লাট্যায়ন ও দ্রাহ্যায়ন শ্রৌতসূত্র; যজুর্বেদের ছখানি শ্রৌতসূত্র বৌধায়ন, আপস্তম্ব, হিরণ্যকেশি, ভারদ্বাজ, মানব ও বৈখানস। বৌধায়ন কল্পসূত্রে প্রাচীন আর্যদের জ্যামিতিতত্ত্ব ও শুল্বসূত্র নিবন্ধ আছে। শুক্লযজুর্বেদের কল্পসূত্র হল- কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র এবং পারস্কর গৃহ্যসূত্র।
কল্পশাস্ত্রের প্রণেতা হিসাবে আশ্বলায়ন, সাংখ্যায়ন, বৌধায়ন, কাত্যায়ন, আপস্তম্ব প্রভৃতি ঋষির নাম সুপ্রসিদ্ধ। সংক্ষিপ্ত বাক্যের মাধ্যমে সর্বতোমুখী ভাবকে নিবন্ধ করাই সূত্রশাস্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কল্প নামক বেদাঙ্গ থেকেই ক্রমশ এক সুবিশাল সূত্রসাহিত্য গড়ে উঠেছে।
বেদ | শ্রৌতসূত্র | গৃহ্যসূত্র | ধর্মসূত্র |
ঋগ্বেদ | আশ্বলায়ন, সাংখ্যায়ন | আশ্বলায়ন, সাংখ্যায়ন | বসিষ্ঠ |
সামবেদ | লাট্যায়ন, দ্রাহ্যায়ন, জৈমিনীয় | দ্রাহ্যায়ন, গোভিল, জৈমিনীয় খাদির | গৌতম |
শুক্ল যজুর্বেদ | কাত্যায়ন | পারস্কর বা বাজসনেয়ি, | শঙ্খলিখিত |
কৃষ্ণযজুর্বেদ | বৌধায়ন, আপস্তম্ব, মানব, সত্যাষাঢ় বা হিরণ্যকেশী, বৈখানস | বৌধায়ন, আপস্তম্ব, মানব, হিরণাকেশী, ভারদ্বাজ, বারাহ, কাঠক, লৌগাক্ষি, বৈখানস, বাধুল | মানব, বৌধায়ন, আপস্তম্ব, হিরণ্যকেশী বৈখানস |
অথর্ববেদ | বৈতান | কৌশিক | পঠিনাসী |
বেদাঙ্গ – ব্যাকরণ
মহাবৈয়াকরণ, পতঞ্জলি বেদাঙ্গ হিসাবে ব্যাকরণের প্রাধান্য স্বীকার করেছেন—’প্রধানং চ ষট্ স্বঙ্গেষু ব্যাকরণম্।’ ব্যাকরণকে বেদপুরুষের মুখরূপে কল্পনা করাতেও ব্যাকরণের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে—’মুখং ব্যাকরণম্ স্মৃতম্।’ ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভের জন্য ব্যাকরণ শাস্ত্রের জ্ঞান অপরিহার্য। বেদপাঠে ব্যাকরণের অপরিহার্য প্রয়োজনের কথা বলতে গিয়ে ব্যাকরণকে ‘বেদানাং বেদঃ’ বলা হয়েছে। সন্ধি-সমাস শব্দরূপ-ধাতুরূপ-প্রকৃতিপ্রত্যয়াদি বিষয়ে সম্যক জ্ঞানলাভ ব্যাকরণ ছাড়া হয় না। অতিপ্রাচীনকাল থেকেই ব্যাকরণ চর্চার প্রচলন ছিল, কিন্তু ব্যাকরণের প্রাচীন কোনো গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। বর্তমান কালে মহাবৈয়াকরণ পাণিনিধিরচিত ‘অষ্টাধ্যায়ী’ নামক ব্যাকরণ গ্রন্থকেই বেদাঙ্গ বলে মনে করা হয়। পাণিনি তাঁর গ্রন্থে কয়েকজন প্রাচীন বৈয়াকরণের নামোল্লেখ করেছেন; কিন্তু তাঁদের কোনো গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। আপিশলি, স্ফোটায়ন, শাকল্য এঁরা সকলেই পাণিনি পূর্ব বৈয়াকরণ। অষ্টাধ্যায়ীতে প্রায় চারহাজার সূত্রে, আটটি অধ্যায়ে ব্যাকরণশাস্ত্রে জ্ঞানার্জনের বিপুল আয়োজন করা হয়েছে। অষ্টাধ্যায়ীতে বৈদিক ব্যাকরণও আলোচিত হয়েছে। বর্তমানে পাণিনির সূত্র, কাত্যায়নের বার্তিক এবং পতঞ্জলির মহাভাষ্য ব্যাকরণের অপরিহার্য। অঙ্গ—ব্যাকরণ বলতে এঁদের সম্মিলিত রচনা সম্ভারকেই বোঝায়। এজন্য এঁদেরকে একত্রে ‘ত্রিমুনি ব্যাকরণম্’ বলা হয়।
কলাপ, মুগ্ধবোধ, সারস্বত রত্নমালা প্রভৃতি ব্যাকরণে বৈদিক ব্যাকরণের আলোচনা নেই; এদিক থেকে অষ্টাধ্যায়ীই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ। ব্যাকরণশাস্ত্রের প্রয়োজনের কথা বোঝবার জন্য বার্তিকে বলা হয়েছে—’রক্ষোহাগমলঘ্বসন্দেহাঃ প্রয়োজনম্’- রক্ষা, উহ্য, আগম, লঘুত্ব ও অসন্দেহের জন্য ব্যাকরণশাস্ত্রের অপরিহার্য প্রয়োজন আছে। ব্যাকরণশাস্ত্রের এই অপরিহার্য প্রয়োজনের কথা স্মরণ করেই ‘বাক্যপদীয়’ প্রণেতা ভর্তৃহরি ব্যাকরণকে অপবর্গের বা মোক্ষলাভের দ্বার বলেছেন—
“তদ্দ্বারমপবর্গস্য বাঙ্মলানাং চিকিৎসিতম্।
সর্ববিদ্যাপবিদ্রোহয়মধিবিদ্যং প্রকাশতে ।।”
বেদাঙ্গ – নিরুক্ত
বেদমন্ত্রের প্রকৃত অর্থের উপলব্ধির জন্য অতিপ্রয়োজনীয় আর একটি বেদাঙ্গের নাম নিরুক্ত। নিরুক্তযাস্ক রচিত। নির্ নিঃশেষরূপে পদসমূহ যাতে উক্ত হয়েছে, নিরুক্ত বলে। দুরূহ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থোপলব্ধিতে নিরুক্ত অপরিহার্য। নিরুক্তের আগে নিঘন্টু নামে এক শ্রেণীর গ্রন্থ ছিল, সেগুলিকে প্রাচীন শব্দকোষ বা অভিধান বলা যায়। আচার্য যাস্কের ‘নিরুক্তম্’ গ্রন্থটিই প্রাচীন নিঘন্টুর ব্যাখ্যা বলে মনে করা হয়। কোন্ শব্দ বেদে কোন্ বিশেষ অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে, শব্দের নিত্যত্ব বিচার, দেবতাতত্ত্ব, উপসর্গ, নিপাত প্রভৃতির লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য, দেবতাগণের উৎপত্তি বিষয়ক আলোচনা, প্রাকৃতিক শক্তির অন্তরালে ঐশীশক্তির ভাবকল্পনা, বেদের বহুদেবতা প্রকৃতপক্ষে একই পরমাত্মার বিভিন্ন বিকাশ ইত্যাদি দার্শনিক ও তাত্ত্বিক আলোচনা আচার্য যাস্ক তাঁর নিরুক্ত গ্রন্থে করেছেন। ‘নিরুক্তম্’ গ্রন্থটি প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন নিঘন্টুর টীকা। নিঘণ্টুতে আছে শব্দের পাঁচটি তালিকা, তিনটি কাণ্ড। তিনটি কাণ্ড হল— নৈঘটুক কাণ্ড, নৈগম কাণ্ড এবং দৈবত কাণ্ড। অনুক্রমনিকা ভাষ্যে তিনটি বিভাগের উল্লেখ আছে—
আদ্যং নৈঘন্টুকং কাণ্ডং দ্বিতীয়ং নৈগমং তথা।
তৃতীয়ং দৈবতঞ্চেতি সমাম্নায়স্ত্রিধা স্থিতঃ ।
এই তিনটি বিভাগকে নিরুক্তের তিনটি কাণ্ড বলা হয়। প্রতি কাণ্ডের কয়েকটি করে অধ্যায় আছে। নৈঘণ্টুক কাণ্ডের পাঁচটি অধ্যায়, নৈগম কাণ্ডের ছয়টি অধ্যায় এবং দৈবত কাণ্ডের ছয়টি অধ্যায়, সর্বসমেত এই সপ্তদশ অধ্যায় নিরুক্ত গ্রন্থে আছে।
নৈঘটুক কাণ্ডে তিনটি তালিকায় কতকগুলি বিশেষ অর্থবোধক শব্দ সংগৃহীত হয়েছে। এখানে পৃথিবী বাচক 21 টি, স্বর্ণবাচক 15 টি, বায়ুবাচক 16 টি, জলবাচক 101 টি, গত্যর্থকয়122 টি এবং রাত্রির 23 টি, দিবসের 12টি, ঊষার 16টি নাম এইরূপ বেদে ব্যবহৃত বহু শব্দের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। নিঘণ্ট পরবর্তী কালের অমরকোষ, মেদিনীকোষ, হুলায়ুধ, বৈজয়ন্তী প্রভৃতি কোষগ্রন্থের উৎস। নৈগমকাণ্ডে বৈদিব দুরূহ শব্দগুলির একটি তালিকা আছে। দৈবতকাণ্ডে আছে দ্যুলোক, ভুলোক ও অন্তরিক্ষলোকের দেবতাগণের একত্রীকরণ। নৈগমনকাণ্ড ভাষাতত্ত্বের প্রথম নিদর্শন।
নিরুক্তগ্রন্থে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাও পরিচয় পাওয়া যায়। বিদ্যুৎজনিত অগ্নি ও পার্থিব অগ্নির পার্থক্য দেখানো হয়েছে, সূর্যের দীপ্তিতেই চন্দ্রের দীপ্তি এমন কথা দেখা যায়—’আদিত্যোঽস্য দীপ্তির্ভবতি।
যাস্কাচার্যের নিরুক্তম্ গ্রন্থে শাকপূর্ণি, ঊর্ণনাভ প্রভৃতি প্রাচীন নিরুক্তকারের নাম জানা যায়, কিন্তু তাঁদের রচিত কোনো গ্রন্থ পাওয়া যায় না। আচার্য যাস্কের আবির্ভাবকাল খৃ. পূ. ষষ্ঠ শতাব্দী বলে মনে করা হয়। অনেকের মতে নিঘন্টু এবং নিরুক্ত উভয় জাতীয় গ্রন্থের রচয়িতাই ছিলেন আচার্য যাস্ক।
বেদাঙ্গ – ছন্দঃ
যজুর্বেদের গদ্যাত্মক মন্ত্রগুলি বাদ দিলে এ যুগের বিপুল রচনা সম্ভার সবই পদ্যাত্মক, ছন্দোবদ্ধ। ছন্দশাস্ত্রকে বেদপুরুষের চরণরূপে কল্পনা করা হয়েছে। নৃত্যের ছন্দ, চলার ভঙ্গিমা যেমন চিত্তে দোলা দেয় সাহিত্যে ছন্দও তেমনি সহৃদয় হৃদয়ে দোলা জাগায়। সাহিত্যে ছন্দর গুরুত্ব অপরিসীম । ছন্দঃশাস্ত্রের জ্ঞানভিন্ন বেদার্থের জ্ঞান হয় না। পতঞ্জলির মতে ছন্দোহীন বাক্য যজমানকে হত্যা করে।
পিঙ্গল মুনি রচিত ছন্দঃসূত্র গ্রন্থটি সম্ভবত প্রাচীনতম ছন্দোগ্রন্থ। গ্রন্থটির দুটি রূপ আছে—প্রথমটি বৈদিক এবং দ্বিতীয়টিতে বৈদিকোত্তর সংস্কৃত ছন্দের বৈশিষ্ট্য আলোচিত হয়েছে। অনেকের মতে গ্রন্থের দুটি অংশ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিকর্তৃক রচিত হয়েছে। বেদাঙ্গ হিসাবে ছন্দঃসূত্র অর্বাচীন কালের রচনা বলে মনে করা হয়।
বৈদিক ছন্দঃ অক্ষর সংখার উপর নির্ভর করে—’যদক্ষরপরিমাণং তচ্ছন্দঃ।’ সংস্কৃত ছন্দ সমবৃত্ত, বিষমবৃত্ত ও অর্ধসমবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, জাতি ইত্যাদি নানাবিধ।
বৈদিকছন্দ সাধারণত সাতটি — গায়ত্রী, উষ্ণিক, অনুষ্টুপ, বৃহতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুপ ও জগতী। স্বল্পাক্ষরা গায়ত্রী; এর অক্ষরসংখ্যা 24, প্রতিপাদে আটটি করে অক্ষর। ঋগ্বেদের প্রথম মন্ত্রই গায়ত্রীছন্দে নিবদ্ধ। ‘অগ্নিমীলে পুরোহিত = আট অক্ষর। যজ্ঞস্য দেবমৃত্তিজম্ = আট অক্ষর, হোতারং রত্নধাতমম্ = আট অক্ষর, গায়ত্রী ছন্দে ক্রমানুসারে = চারটি অক্ষর বর্ধিত করলে অন্য ছন্দগুলি হয়।
বৈদিকছন্দ | অক্ষরসংখ্যা |
গায়ত্রী | 24 |
উষ্ণিক | 28 |
অনুষ্টুপ | 32 |
বৃহতী | 36 |
পংক্তি | 40 |
ত্রিষ্টুপ | 44 |
জগতী | 48 |
মন্ত্রপাঠে ছন্দের গুরুত্ব বিভিন্নগ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। যাস্কাচার্যের মতে ‘ছন্দাংসি ছাদনা’ ছন্দ যজমান ও পুরোহিতগণের পাপকে আচ্ছাদিত করে। তৈত্তিরীয় সংহিতায় একটি উপাখ্যান দৃষ্ট হয়; সেখানে বলা হয়েছে প্রজাপতি অগ্নিচয়ন করলে সেই অগ্নি ভয়ংকর রূপ পরিগ্রহ করে, দেবতারা সেই অগ্নির নিকট যেতে সাহস করলেন না। অতঃপর ছন্দের দ্বারা নিজেদের শরীর আচ্ছাদন করে দেবতারা অতিসহজেই সেই অগ্নির সমীপে গমন করলেন, তাঁদের কোনো ক্ষতি হল। না। অতএব বেদমন্ত্র উচ্চারণে ছন্দের অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা আছে মনে করা হয়। ছন্দের মাধুর্যগুণে মন্ত্র সঙ্গীতমুখর, শ্রুতিসুখকর ও আনন্দদায়ক হয়। ছন্দ আনন্দ দেয়, ছান্দাগ্য উপনিষদের মতে দেবতাগণকে মৃত্যুঞ্জয়ী করেছে ছন্দ।
বেদের সাতটি ছন্দকে বেদরূণী পরম পুরুষের সাতটি হস্তরূপে কল্পনা করা হয়েছে। কেউ কেউ যজ্ঞরূণী পুরুষের সাতটি হাত বলেছেন। ঋগ্বেদের একটি মন্ত্র –
‘চত্বারি শৃঙ্গাস্ত্রয়োহস্য পাদা
দ্বে শীর্ষে সপ্ত হস্তাসো অস্য
ত্রিধা বদ্ধো বৃষভো রোরবীতি
মহো দেবো মৰ্ত্ত্যা আবিবেশ।।’
যজ্ঞরূপী বিশাল দেবতা মর্ত্যলোকে আবির্ভূত হয়েছেন; তাঁহার চারটি শৃঙ্গ, তিনটি পা, দুটি মাথা, সাতটি হাত, তিনটি বন্ধনরজ্জু, তিনি বৃষভ ও শব্দকারী। হোতা, উদ্গাতা, অধ্বর্যু ও ব্রহ্মা চারজন পুরোহিতের কর্ম যজ্ঞের চারটি শৃঙ্গ। প্রাতঃসবন, মাধ্যন্দিনসবন ও তৃতীয়সবন সোমারসের এই ত্রিসন্ধ্যায় তিনবার আহুতি তাঁর তিনটি পা। যজমান ও যজমানপত্নী তাঁর দুইটি মাথা। গায়ত্রী প্রভৃতি সাতটি ছন্দ তাঁর সপ্তহস্ত। ঋক্, সাম ও যজুঃ এই বেদত্রয় তাঁর তিনটি বন্ধন। তিনি যজমানের কাম্যবস্তু বর্ষণ করেন, দান করেন বলে তিনি বৃষভ। যজ্ঞে উচ্চারিত শস্ত্র ও স্তোত্র মন্ত্ররাজি তার নির্ঘোষ। গানরহিত মন্ত্র পাঠকে শস্ত্র এবং গানপাঠকে স্তোত্র বলে। পিঙ্গলঋষিবিরচিত ছন্দঃসূত্রকেই বেদাঙ্গ বলে ধরা হয় ।
বেদাঙ্গ – জ্যোতিষ
বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের যথাযথ কাল নির্ধারণ জন্য জ্যোতিষের জ্ঞান আবশ্যক। রাশি , নক্ষত্র, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, সংক্রান্তি, সংবৎসর নক্ষত্র, প্রভৃতির জ্ঞান না থাকলে বৈদিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান অসম্ভব। প্রত্যেক যজ্ঞের প্রত্যেক শ্রৌত ও গৃহ্য কর্মের বিশিষ্ট কাল, তিথি, ঋতু প্রভৃতির বিধান আছে। ‘গবাময়ন’ নামক সূত্র, দীর্ঘকালব্যাপীযজ্ঞ একবৎসরে শেষ হয়। 361 দিন ব্যাপী এই যজ্ঞের অনুষ্ঠান হয়। ‘অভিপ্লবষড়হ’, পৃষ্ঠষড়হ প্রভৃতি যজ্ঞ ছয়দিনে সম্পাদ্য। দ্বাদশাহ নামক যাগ বারদিনে সম্পন্ন হয়। অতএব যজ্ঞসম্পাদনের ক্ষেত্রে মাস, দিন, ঋতু, তিথি, নক্ষত্র, সংবৎসর প্রভৃতির জ্ঞান না থাকলে বৈদিক কর্মানুষ্ঠান অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই কারণেই জ্যোতিষশাস্ত্রের অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন। লগধমুনির মতে—
“বেদা হি যজ্ঞার্থম্ অভিপ্রবৃত্তাঃ
কালানুপূর্বা বিহিতাশ্চ যজ্ঞাঃ।
তস্মাদিদং কালবিজ্ঞানশাস্ত্রং
যো জ্যোতিষং বেদ স বেদ যজ্ঞম্”
জ্যোতিষশাস্ত্রকে গণিত বিজ্ঞান বলে মনে করা হয়। ঋগ্বেদীয় বেদাঙ্গ জ্যোতিষ এবং যজুর্বেদীয় বেদাঙ্গ জ্যোতিষ বর্তমানে বিদ্যমান আছে। ইউরোপীয় বিবুধগণের মতে এই দুই জ্যোতিষগ্রন্থ বৈদিকোত্তর যুগের রচনা। কিন্তু গ্রন্থ দুটি কোনো অবস্থাতেই 1400 – 1200 খৃঃ পূর্বাব্দের পরে নয়।
ঋগ্বেদের বহুস্থলেই তিথি গণনা, নক্ষত্রগণনা , মলমাসগণনা , ঋতুগণনা উল্লিখিত হয়েছে। সামবেদের তাণ্ড্যমহাব্রাহ্মণে ফাল্গুনমাসের পূর্ণিমা তিথিতে দীক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে— “ফাল্গুনীপৌর্ণমাসে দীক্ষেরন্।’ তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের মতে ব্যতীত, বহু বেদ মন্ত্রের অর্থবোধের জন্যও মাস, তিথি, নক্ষত্র, কাল, বৎসরাদির জ্ঞান অত্যন্ত প্রয়োজন।
ধন্যবাদ
আমাদের www.sanskritruprekha.com সাইট Visit করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সংস্কৃতের আরো অনেক তথ্য পাওয়ার জন্য Home Page আসুন। Home Page পৌঁছানোর জন্য CLICK HERE👈
আমদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে CLICK HERE👈