ভবভূতির উত্তররামচরিত নাটক

কালিদাস পরবর্তী নাট্যকারদের মধ্যে অন্যতম সর্বশ্রষ্ঠ ভবভূতির উত্তররামচরিত নাটক। এই নাটক সম্পর্কে টীকা লেখা হল। ভবভূতির উত্তররামচরিত নাটক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থীদের জন্য একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংস্কৃত অনার্স ছাত্র ছাত্রীদের এই অধ্যায় খুঁটিয়ে পড়তে হবে। এছাড়া WBSSC এর SLST পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আমরা যাকে সাহিত্য বলি, সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রে তাই কাব্য নামে চিহ্নিত। রসাত্মক বাক্যে গুণ, অলংকারের মন্ডন ছাড়িয়ে কাব্যের অন্তর্গঢ় রসরূপ সহৃদয় পাঠকের মন আপ্লুত করে।সংস্কৃত সাহিত্যে ‘কাব্যং দ্বিবিধং দৃশ্যং শ্রব্যং চ’ অর্থাৎ কাব্য দুই প্রকার দৃশ্যকাব্য ও শ্রব্যকাব্য। দৃশ্যকাব্যের আধুনিক প্রতিশব্দ নাটক। মঞ্চে অভিনয় দর্শনের মাধ্যমে দৃশ্যকাব্য উপস্থাপিত হয়। এই দৃশ্যকাব্যের অপর নাম রূপক; কারণ এতে পাত্র-পাত্রীর উপর, নাটকীয় চরিত্রের রূপ আরোপ করা হয়। এই দৃশ্যকাব্য বা রূপক দশ প্রকার। ভবভূতির উত্তররামচরিত নাটক সংস্কৃত সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ দৃশ্যকাব্য।

ভবভূতির উত্তররামচরিত নাটক সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর বা টীকা লেখ। Uttarramcharit in Bengali কালিদাস পরবর্তী নাট্যকারদের মধ্যে ভবভূতি অন্যতম। ভবভূতি নিজের কথা তাঁর রচনায় কিছু কিছু বলেছেন। কিন্তু নিজের কালের কোনো তথ্য আমাদের দিয়ে যাননি। যাইহোক, ভবভূতির উত্তররামচরিত, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থীদের জন্য একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংস্কৃত অনার্স ছাত্র ছাত্রীদের এই অধ্যায় খুঁটিয়ে পড়তে হবে। এছাড়া WBSSC এর SLST পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

উত্তররামচরিতভবভূতি
অঙ্ক সংখ্যা7 টি
উৎসরামায়ণ
শ্রেণিনাটক
নায়করামচন্দ্র
নায়িকাসীতাদেবী
মুখ্যরসকরুন

উত্তররামচরিত সম্পর্কে আলোচনা কর

ভূমিকা – সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যে কবি কালিদাসের পরেই ‘শ্রীকণ্ঠ-পদ-লাঞ্ছন’ ভবভূতির স্থান। দেহরূপের অন্তরালে মানুষের মনোরাজ্যে শোক ও দুঃখের যে প্রচ্ছন্ন অবস্থা, তাকে অনুভূতির উষ্ণতায় দ্রবীভূত করে নাট্যধারায় উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে ভবভূতি অদ্বিতীয়। মহর্ষি বাল্মীকি রচিত রামায়ণ এবং পদ্মপুরাণের পাতলখণ্ড অবলম্বনে সাত অঙ্কে রচিত নাটক “উত্তররামচরিত “।

কবি পরিচিতি :- দক্ষিণাপথে বিদর্ভ অঞ্চলে পদ্মপুর নগর ভবভূতির পুরুষানুক্রমে বাসস্থান। কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় শাখা তাঁদের বংশানুক্রমিক চর্চার বিষয়। কাশ্যপ গোত্রের এই পণ্ডিত বংশের উপাধি নাম ছিল উদুম্বর। ভবভূতির ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ মহাকবি, পিতামহ ভট্টগোপাল, পিতা নীলকণ্ঠ, মাতা জাতুকর্ণী।

রচনাকাল :- ভবভূতি নিজের কথা তাঁর রচনায় কিছু কিছু বলেছেন। কিন্তু নিজের কালের কোনো তথ্য আমাদের দিয়ে যাননি। রাজশেখর সর্ব প্রথম তাঁর বালরামায়ণে ভবভূতির উল্লেখ করেছেন। ভবভূতির রচনাংশ সর্ব প্রথম উদ্ধৃত হয়েছে বামনের কাব্যালঙ্কারে। ভবভূতির উপর কালিদাসের প্রভাব নিঃসংশয়ে পড়েছে। প্রেমকাতর মাধব যখন মালতীর অনুসন্ধানে রত, কিংবা মেঘকে দৌত্যে নিযুক্ত করে মালতীর নিকট প্রেরণ করতে উদ্যত তখন তাতে কালিদাসের পুরুরবা ও যক্ষের প্রভাবই দেখা যায়। কলহণের মতে কনৌজেশ্বর যশোবর্মন, ভবভূতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং ভবভূতি ও বাক্পতি উভয়েই তাঁহার সভাকবি ছিলেন। কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্য কর্তৃক (৬৯৯-৭৩৫ খৃঃ অঃ) যশোবর্মন পরাভূত হন। বাক্পতিরাজ তাঁর গৌড়বহে যশোবর্মনের প্রশংসা করেছেন এবং ভবভূতির নিকট নিজের ঋণ স্বীকার করেছেন। গৌড়বহের রচনাকাল ধরা হয় ৭৩৬ খৃস্টাব্দ। তখনও ললিতাদিত্যের নিকট যশোবর্মনের পরাজয় ঘটেনি। কাজেই খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের শেষভাগ বা অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগ ভবভূতি উত্তররামচরিত রচনা করেন বলে , অধিকাংশ পণ্ডিত স্বীকার করেন।

উৎস :- নাট্যকার ভবভূতি রামায়ণের কাহিনী অবলম্বনে উত্তররামচরিত নাটক রচনা করেন। রামায়ণের উত্তরকান্ড এবং পদ্মপুরাণের পাতলখণ্ড থেকে এই নাটকের বিষয়বস্তু গৃহীত।

বিষয়বস্তু :- প্রথম অঙ্কের নাম চিত্রদর্শন যার শুরুতে যজ্ঞসভা থেকে গুরুজনদের আশীর্বাদ বয়ে এনেছেন অষ্টাবক্র মুনি। সীতার যে কোনো মনোবাসনা পূরণ ও রামের প্রজানুরঞ্জন প্রসঙ্গ স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই সঙ্গে। এমন সময় চিত্রপটিকায় রামচন্দ্রের জীবনী নিয়ে চিত্রকরের আঁকা ছবি দেখার জন্যে লক্ষ্মণ রাম-সীতাকে আহ্বান জানালেন। চিত্রার্পিত দৃশ্য স্মৃতিভারাতুর চিত্তে দেখতে দেখতে সীতা ভাগীরথী তীরে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে রাম তৎক্ষণাৎ সম্মত হন। ক্লান্ত হয়ে সীতা রামের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন, রাম প্রিয়তমা গৃহলক্ষ্মী পত্নীর চিরন্তন সান্নিধ্য প্রাপ্তির আশায় বিভোর হয়ে আছেন, এমন সময় পরিচারক দুর্মুখ সীতার রাক্ষসগৃহে বাস প্রসঙ্গে প্রজাসমাজে প্রচলিত নিন্দাবাদ বেদনার্ত মনে কর্তব্যের খাতিরে রামকে জানালে সেই তীব্র বাগ্বজ্রের আঘাতে রাম মূর্ছিত হন। কিন্তু রাজকর্তব্য বড়ো ভয়ানক, সেখানে ব্যক্তিগত হৃদয়বৃত্তির স্থান কোথায় ? আজন্মশুদ্ধ সীতার পা দুখানি মাথায় তুলে অশ্রু বিসর্জন করতে পারেন, কিন্তু প্রজানুরঞ্জনের জন্য সীতাকে পরিত্যাগ করার রাজাদেশ রামকে দিতেই হবে। পোষা পাখিকেও কসাই যেমন জবাই করে, প্রিয়তমা সীতাকে তেমনি ভাগীরথীতীরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার ছুতোয় অরক্ষিত অবস্থায় মৃত্যুর হাতে বিসর্জন দিয়ে আসতে হবে। সীতা যেন এতদিন চন্দ্রভ্রমে বিষবৃক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। রাজবধূ হয়েও তিনি অসহায়, অনাথ। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সীতাকে জানানো হয়, লক্ষ্মণ রথ নিয়ে প্রস্তুত। সকলকে নমস্কার জানিয়ে সীতা যাত্রা শুরু করেন।

দ্বিতীয় অঙ্কের ঘটনা তার বারো বছর পর। আত্রেয়ী দণ্ডকারণ্যে জনস্থান বনদেবতা বাসন্তীকে কথা প্রসঙ্গে জানাচ্ছেন, ঋষি প্রাচেস বাল্মীকি লব কুশ নামে দুটি অসামান্য বালকের শিক্ষা নিতে ব্যস্ত, তাদের এগারো বছর বয়সে ক্ষত্রিয়োচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া তমসাতীরে ক্রৌঞ্চমিথুনের মধ্যে ব্যাধের হাতে একটির মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাল্মীকির শোকের উৎসার শ্লোক রূপ পেয়েছিল, তারপর ব্রহ্মার নির্দেশে তিনি রামায়ণ লিখেছেন। শাস্ত্রাধ্যয়নের ব্যাপারে সেখানে অসুবিধা হওয়ায় আত্রেয়ী অগস্ত্যাশ্রমের দিকে চলেছেন। আত্রেয়ীর মুখ থেকে সীতার প্রিয়সখী বাসন্তী সীতাবিসর্জন বৃত্তান্ত, রামচন্দ্রের অশ্বমেধ যজ্ঞ আয়োজন ও তারজন্য হিরণ্ময়ী সীতাপ্রতিমা নির্মাণ, শূদ্র তাপস শম্বুককে বধ করার জন্যে রামের উদ্দেশে দৈববাণী ও সেই উদ্দেশ্যে রামের জনস্থান আগমনের কথা জানতে পারেন। দণ্ডকারণ্য পরিদর্শন রামচন্দ্রের স্মৃতিকে উদ্বেল করে তুলেছে। এক একটি চেনা জায়গা দেখছেন আর মনে হচ্ছে আগের সেই ঘটনাগুলি যেন প্রত্যক্ষ করছেন— “প্রত্যক্ষানির বৃত্তান্তান্ পূর্বান্ অনুভবামি চ”। সীতা এই বন ভালোবাসতেন ভেবে তাঁর আরও কষ্ট। ঘনীভূত শোক নতুন করে তাঁকে বিকল করে দেয়। পঞ্চবটী, ক্রৌঞ্চাবত পাহাড়, গোদাবরী নদী, পবিত্র নদীসংগমের সামনে তিনি সীতার স্মৃতিতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।

তৃতীয় অঙ্কের সূচনায় মুরলা ও তমসা এই দুই নদীর কথোপকথনে জানা যায়, রামচন্দ্রকে আশ্বস্ত করার জন্যে ভাগীরথী কোনো এক গৃহাচার পালনের ছলে গোদাবরীতে এসেছেন, সঙ্গে আছেন সীতা— “করুণস্য মূর্তিরথবা শরীরিণী/বিরহব্যথেব বনমেতি জানকী”। তাঁরও চিত্তে নানা স্মৃতি জাগরূক হয়ে আছে। পঞ্চবটীতে এসে ‘হা প্রিয়ে জানকি’ বলে রাম মূর্ছিত হয়ে পড়লে তমসার কথা অনুসারে সীতা তাঁকে করস্পর্শে সুস্থ করে তুললেন। এ-স্পর্শ রামের সুপরিচিত। কিন্তু সীতা ভাগীরথীর প্রসাদে অদৃশ্য। সীতাবিরহে রামের করুণ বিলাপ ও মর্মভেদী হৃদয়বেদনা সীতা কিন্তু সবই প্রত্যক্ষ করছেন। অদৃশ্য সীতার পাশেই রাম। কিন্তু বারো বছর দীর্ঘ ব্যবধানের পর এই সান্নিধ্যে মিলনের আনন্দ নেই, আছে দুঃসহ বিচ্ছেদব্যথা। বনদেবী বাসন্তী দুজনকেই নানা সুখদুঃখের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। মূর্ছাদশায় সীতার শুশ্রুষা লাভ করে রাম তাঁকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ অনুভব করেও স্থায়ী সুখের আশ্বাস দেখছেন না। স্মৃতি রোমন্থন শেষে একসময় বাসন্তীর কাছে যখন রাম বিদায় চাইলেন, সীতার কাছে সে ক্ষণটি বড়োই বিষাদবিধুর।

চতুর্থ অঙ্কে বিস্কম্ভকদৃশ্যে সৌধাতকি ও দাণ্ডায়ন নামে দুই তাপসের কথাবার্তা থেকে বাল্মীকির তপোবনে দশরথের পত্নীদেরকে ও দেবী অরুন্ধতীকে সঙ্গে নিয়ে বশিষ্ঠের উপস্থিতি এবং রাজর্ষি জনকের আগমন বৃত্তান্ত জানা যায়। সীতা বিসর্জনের ঘটনায় সকলের মন ভারাক্রান্ত। দশরথ ও জনকের সৌহার্দ্য এবং দুই পরিবারের সম্পর্ক স্মরণ করে সে দুঃখ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এই সময় হইচই করে খেলতে থাকা ছেলেদের মধ্যে কৌশল্যা একটি বালকের মুখে সীতা ও রামচন্দ্রের সাদৃশ্য দেখে বিস্মিত হন। রাজর্ষি জনকও তাঁকে দেখে চমৎকৃত হন। ইনি সীতার পুত্র লব, কিন্তু পিতৃমাতৃপরিচয় বলতে পারেন না। লক্ষ্মণের পুত্র চন্দ্রকেতু রাজা রামচন্দ্রের অশ্বমেধের ঘোড়া নিয়ে ততক্ষণে বাল্মীকির আশ্রমপ্রান্তে উপস্থিত। লব রামায়ণী কথার সুবাদে রাম-লক্ষ্মণের বিষয়ে জানেন, তবে তাদের পুত্রদের পরিচয় জানেন না। অরুন্ধতীর মুখে তিনি কৌশল্যা ও জনককে চিনে নেন ও খেলার সঙ্গীদের সঙ্গে ঘোড়া দেখার কৌতূহল মেটাতে গিয়ে অশ্বরক্ষক রাজপুরুষদের উদ্ধৃত বাক্যে ক্ষুদ্ধ হয়ে যজ্ঞাশ্ব আটক করেন।

পঞ্চম অঙ্কে যজ্ঞাশ্ব উদ্ধারের জন্যে সারথি সুমন্ত্রকে নিয়ে ধনুর্বাণ হাতে কুমার চন্দ্রকেতু উপস্থিত। তাঁর সৈন্যদল লবের অস্ত্রপ্রহারে বিপর্যস্ত হয়ে পালিয়ে এসেছে দেখে তিনি নিজেই লবের মুখোমুখি। সুমন্ত্রের চোখে লব বীরপোতঃ এবং দৃপ্তসিংহশাবঃ। রামচন্দ্রের ব্যবহার্য জৃম্ভকাস্ত্র লবের অধিকারে দেখে সুমন্ত্র বিস্মিত হন। তাঁর মনে আশ্চর্য স্নেহভাব জেগেছে। চন্দ্রকেতুও লবকে দেখে মুগ্ধ। লবের মনেও কেমন এক প্রীতির ভাব জেগেছে। চন্দ্রকেতু রথ থেকে নেমে মাটিতে যুদ্ধ করুন, এটা লব চান না, আবার অনভ্যাসবশত নিজেও রথে চাপতে অনাগ্রহী। রামচন্দ্র সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল হয়েও তিনি পরশুরামের পরাভবকে রামচন্দ্রের বীরত্বের পরিচায়ক বলতে নারাজ, বালীবধের প্রসঙ্গ তুলে খোঁটা দিতেও তিনি পিছপা নন। এইভাবে কথা কাটাকাটির পর ষষ্ঠ অঙ্কের বিষয় হয় লব ও চন্দ্রকেতুর যুদ্ধ।

নাট্যরীতি অনুসারে কবি যুদ্ধের সাক্ষাৎ উপস্থাপনা করেননি। দুই বিদ্যাধর বিদ্যাধরী আকাশপথে বিচরণ করতে করতে তুমুল যুদ্ধদৃশ্য দেখছেন আর আলোচনা করছেন সেসব—এই কৌশলে যুদ্ধবৃত্তান্ত বর্ণনা করছেন নাট্যকার। চন্দ্রকেতুর অগ্নিবাণের জবাবে লবের বরুণবাণ, তদুত্তরে চন্দ্রকেতুর বায়ুবাণ—এই অবস্থায় রামচন্দ্রের উপস্থিতিতে দুই কুমার অস্ত্রসংবরণ করেন। লব ও চন্দ্রকেতু এখন পরম মিত্রতায় আবদ্ধ হয়ে রামচন্দ্রের সামনে। পিতাপুত্র মুখোমুখি, কেউ কাউকে জানেন না। রামচন্দ্রের পরিচয় পেয়ে বাল্মীকি-শিষ্য হিসেবে আত্মপরিচয় দিয়ে লব রামের স্নেহালিঙ্গন লাভ করলেন। যজ্ঞাশ্ব অনুসরণকারী রাজপুরুষদের ঔদ্ধত্যের প্রতিবাদে যজ্ঞাশ্ব আটক করার কথা বিনীতভাবে লব জানালে রাম তাঁর প্রশংসা করেন। লবের কাছে জৃম্ভকাস্ত্রের কথা জেনে, রামের আশ্চর্য লাগে। লবের যমজ ভাই কুশকে ডেকে তাঁকেও তিনি আলিঙ্গন করে পরমাহ্লাদ লাভ করেন। তাঁর পিতৃস্নেহ এই বালকদের দিকে উৎসারিত হয়, যেন আপন পুত্র তাঁর সামনে। লবকুশের মুখে রাম রামায়ণবৃত্তান্ত শুনতে চান। দুই বালক রাম-সীতার দাম্পত্যপ্রীতির কথা বাল্মীকি রামায়ণ আবৃত্তি করে শোনান।

সপ্তম অঙ্কে গঙ্গাতীরে অপ্সরাদের দিয়ে বাল্মীকি-রচিত নাটক অভিনয়ের আসরে রাম, লক্ষ্মণ, লব, কুশ, চন্দ্রকেতু, পুরবাসী ও গ্রামবাসী প্রজাকুল, সীতা, অরুন্ধতী সকলে উপস্থিত। বনে পরিত্যক্তা সীতা গঙ্গায় আত্মবিসর্জন দিতে নেমেছেন—এখান থেকে নাটকের সূত্রপাত। প্রথম দৃশ্যে দুই সদ্যোজাত পুত্র ও সীতাকে নিয়ে পৃথিবী ও গঙ্গাকে দেখা যায়, তাঁরা সীতাকে পুত্রজন্মের সংবাদ দিয়ে আশ্বস্ত করছেন। কুলদেবতা ভাগীরথী ও সীতার জননী বসুন্ধরা সীতার দুঃখে কাতর। সীতার প্রতি রামের প্রীতিও তাঁদের অজানা নয়। নাটকের মধ্যেই দিব্য জৃম্ভকাস্ত্র আবির্ভূত হল এবং তা যে সীতার দুই পুত্রের অধিকারে বর্তাবে সে কথা ভাগীরথী ও বসুন্ধরা জানালেন। পুত্রদের বড়ো না হওয়া পর্যন্ত বসুন্ধরা দুঃখিনী সীতাকে জীবন ধারণ করার পরামর্শ দিলেন। দর্শক আসনে বসে রাম, লক্ষ্মণ এইসব দৃশ্য দেখছিলেন। সীতার দুই পুত্র সম্বন্ধে ভেবে তাঁরা লব কুশকেই সেই দুজন বলে স্থির সিদ্ধান্ত করেন। মধ্য থেকে সীতার নিষ্ক্রমণে দর্শক রাম মূর্ছাগ্রস্ত হন। এমন সময় নেপথ্যে ঘোষিত হয়, গঙ্গা ও পৃথিবী দেবী অরুন্ধতীর হাতে সীতাকে অর্পণ করেছেন— “অর্পিতেয়ং তবাবাভ্যাং সীতা পুণ্যব্রতা বন্ধুঃ”। সীতা অরুন্ধতীর সঙ্গে সশরীরে এসে রামকে শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তোলেন এবং রামের হাতে অরুন্ধতী সীতাকে তুলে দিয়ে বলেন— “নিয়োজয় যথাধর্মং প্রিয়াং ত্বং ধর্মচারিণীম্”। বাল্মীকি তখন লবকুশকে সীতার কাছে পৌঁছে দেন। এইভাবে মিলনান্ত পরিণতিতে উত্তররামচরিত শেষ হয়। এই মিলনান্ত পরিণতির জন্যে নাট্যকার এক অভিনব কৌশল তৈরি করেছেন। বাল্মীকির আশ্রমে রাম দেখছেন বাল্মীকি রচিত নাটক, যার প্রথম দৃশ্যে দেখানো হল সীতা বিসর্জনের ঘটনা যা দেখে রাম মূর্ছিত হলেন এবং সীতার স্পর্শে চৈতন্য ফিরে পেলেন। রাম-সীতার পুনর্মিলনের এই যে নাটকের মধ্যে নাটকের অবতারণা, এ কৌশল ভবভূতির নিজস্ব। এইভাবে রামায়ণ কাহিনিকে নতুনকালের জন্যে নতুন করে লিখলেন ভবভূতি।

নাট্যবৈশিষ্ট্য :- এই নাটকের বৈশিষ্ট্যগুলি হল–

  • ১) উত্তররামচরিত নাটকে কবির মানসিক উৎকর্ষ নাট্যকুশলতা, মানবচরিত্রে অভিজ্ঞতা ও জীবনের মূল্যবোধগুলি পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।
  • ২) ভবভূতির প্রেম স্পর্শকাতর, স্পর্শে অভিভূত এবং সঞ্জীবিত। বাৎসল্য, বন্ধুপ্রীতি, প্রেম সর্বত্রই এই এক রসের প্রকারভেদ। তিনি বিরহেও প্রেমের সৌন্দর্য অবিষ্কার করেছেন।
  • ৩) চরিত্রচিত্রণে ভবভূতি যথেষ্ট সার্থকতা দেখিয়েছেন – রাম ও সীতার চরিত্র মহিমোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে রাম তাঁর প্রভানুরঞ্জন ব্রতে অটল থেকে মহৎশক্তি ও অশেষ দুঃখ সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, সীতা তাঁর পবিত্রতা, কোমলতা ও পাতিব্রত্যের শক্তিতে প্রায় ঐশ্বরীয় মূর্তি লাভ করেছেন।
  • ৪) ভবভূতির রচনায় নাটকীয় ঘটনা-সংস্থান ও কাব্যসুষমা দুটি গুণেরই সুন্দর সমন্বয় ঘটেছে। চিত্রদর্শন দৃশ্যে যে প্রতিক্রিয়া হয়, তার মধ্যে মিশে আছে একাধারে বিয়োগান্তক পরিণতিজনিত বিষাদ ও অপরিমেয় ভালোবাসা। তৃতীয় অঙ্কে রাম ও ছায়া সীতার দৃশ্যের আবেদন অতুলনীয়। একদিকে রামের অসহায়তা, অন্যদিকে বাসন্তীর ক্রোধ ও যন্ত্রণা, এগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সীতার অনুভূতির বৈচিত্র্য।
  • ৫) ভবভূতির আর-একটি গুণ প্রাকৃতিক দৃশ্যের অপরূপ বর্ণনা। যেমন – পঞবটীর অরণ্যশ্রী, জনস্থানের গিরিনদীর বর্ণনা, বনদেবী বাসন্তী, মুরলা, তমসা, ভাগীরথী প্রভৃতি।
  • ৬) বিভিন্ন রসের উদ্ভাবনে যেমন – বীর, করুণ, রৌদ্র, অদ্ভুত ভয়ানক এবং শৃঙ্গার ভবভূতির ক্ষমতা অপরিসীম।
  • ৭) করুণ রস সৃষ্টিতে ভবভূতি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাই বলা হয় – “কারুণ্যং ভবভূতিরেব তনুতে।” উত্তররামচরিতে করুণ রসের অপূর্ব বর্ণনায় “অপি গ্রাবা রোদিত্যপি দলতি বজ্রস্য হৃদয়ম্”। পাষাণও কেঁদে ওঠে, বজ্রও বিগলিত হয়। করুণ রসেরই সকল রসের যে পর্যবসান তা কবি নিজেই বলেছেন – “একো রসঃ করুণ এব নিমিত্তভেদাদ্ / ভিন্নঃ পৃথক্ পৃথগিবাশ্রয়তে বিবর্তান্”।

সমালোচনা :- উত্তররামচরিত ভবভূতির শ্রেষ্ঠ রচনা। গল্পের ভিত্তি রামায়ণের পরবর্তীভাগ অর্থাৎ উত্তরকাণ্ড। এখানে নাট্যকার কাহিনিতে নানা পরিবর্তন সাধন করেছেন। বাল্মীকি রামায়ণ ও কালিদাসের রঘুবংশ অনুযায়ী সীতা উদ্ধার শেষে অযোধ্যার রাজ্যাভিষেকের পর রামরাজত্বকালে সীতার রাক্ষসগৃহে বাস নিয়ে প্রজাদের মধ্যে যে অস্বস্তির মনোভাব ছিল তা জেনে রাম সীতাকে পরিত্যাগ করেন। বাল্মীকির আশ্রমে তিনি আশ্রয় পান এবং সেখানে দুটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন। অশ্বমেধ যজ্ঞসভায় বাল্মীকির সঙ্গে এই দুই বালক এসে রামায়ণ গান শোনায়। তা থেকে যাবতীয় বৃত্তান্ত জেনে সীতাকে রাম যজ্ঞসভায় আনার ব্যবস্থা করেন। সেখানে পুনরায় চরিত্রশুদ্ধি প্রমাণের জন্যে অগ্নিপরীক্ষার প্রস্তাব উঠলে সীতা মা ধরিত্রীর কোলে আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং অলৌকিক ঘটনাক্রমে সীতার পাতাল প্রবেশ হয়। এই মর্মন্তুদ বিয়োগান্তক পরিণতি ভবভূতি স্বীকার করেননি। পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ডে চার সহস্রাধিক শ্লোকে রামকথা বর্ণনার শেষভাগে যেভাবে রাম-সীতার পুনর্মিলন ও সুখী উত্তরজীবন কল্পিত হয়েছে, ভবভূতি সম্ভবত সেই সূত্র ধরে তাঁর নাটকের মিলনান্ত পরিণতি রচনা করেছেন। এখানেও রাম-সীতা তাঁদের দুই পুত্রকে অবশেষে ফিরে পেয়েছেন এবং ওই ঘটনায় নাটকের সমাপ্তি। রামকথা ভবভূতির শ্রদ্ধালু দৃষ্টিতে “মঙ্গল্যা চ মনোহরা চ জগতো মাতেব গঙ্গেব চ”। কাহিনির বিকৃতি নয়, ভবভূতি শ্রদ্ধাভরে পুরাণদর্শিত পথে তার মধ্যে মিলনান্ত সম্ভাবনা বিকশিত করে তুলছেন এবং নাটকে বাল্মীকির চরিত্রের উপস্থিতি ঘটিয়ে তাঁর সামনে ঋষি বশিষ্ঠের পত্নী অরুন্ধতীর মাধ্যমে সীতা ও তাঁর দুটি পুত্রকে রামের হাতে তুলে দেওয়ার ইতিবৃত্ত বিন্যস্ত করেছেন। এ নাটকে রামচন্দ্রের মুখ দিয়ে ভরতবাক্যে ভবভূতির প্রার্থনা— “তামেতাং পরি ভাবয়ন্ত্বভিনয়ৈর্বিন্যস্তরূপাং বুধাঃ” অর্থাৎ অভিনয়ের মাধ্যমে নাট্যাকারে বিন্যস্ত এই রামকথাটি যেন পণ্ডিতবর্গের আনুকূল্যে ব্যাপক প্রচার পায়। করুণরসবহুল সীতাবৃত্তান্তে রাম-সীতার হাহাকার, হৃদয়প্লাবী দুঃসহ অন্তর্বেদনা ও নিদারুণ পরিণামের অনুভব থেকে ভাবীকালের পাঠক-দর্শক সমাজকে কি নাট্যকার মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন ? এ-বিষয়ে কবির স্বাধিকার তিনি স্বচ্ছন্দে প্রয়োগ করেছেন। নায়ক ও রসের অনুকূলে সুপ্রসিদ্ধ মহাকাব্যিক কাহিনিতে যথোচিত বৈচিত্র্যসম্পাদন নাট্যতাত্ত্বিকদের অনুমোদিত। এই স্বাধীনতার সুবাদে স্মৃতিবিজড়িত দণ্ডকারণ্যে নৈসর্গিক বস্তুরাশির সামনে রামচন্দ্রকে উপস্থিত করার সঙ্গে সঙ্গে সীতার অদৃশ্য উপস্থিতি রচনা করে ভবভূতি নাটকীয় পরিস্থিতি গড়ে তুলেছেন। অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব আটক করা নিয়ে লবের সঙ্গে লক্ষ্মণের পুত্র চন্দ্রকেতুর যুদ্ধ এবং পরিচয় প্রকাশের আগেই দুজনের ঘনিষ্ঠ মৈত্রী, কিংবা বাল্মীকির আশ্রমে ইক্ষ্বাকুবংশের কুলগুরু বশিষ্ঠ, তাঁর পত্নী অরুন্ধতী, রামচন্দ্রের মা কৌশল্যা, রাজর্ষি জনক প্রভৃতির উপস্থিতি ভবভূতির কল্পনাপ্রসূত। উত্তররামচরিতে মুরলা ও তমসানদীকে চেতন চরিত্র হিসেবে নাটকীয় বৃত্তান্তে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। উত্তররামচরিত প্রস্তাবনায় জানানো হয়েছে, গর্ভিনী সীতাকে রাজধানীতে রেখে রামচন্দ্রের মায়েরা ঋষি বশিষ্ঠ ও অরুন্ধতীর সঙ্গে জামাতা ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির দ্বাদশ বার্ষিক সত্রে যোগদান করতে গেছেন, রাজর্ষি জনকও বিদেহরাজ্যে ফিরে গেছেন।

মূল্যায়ণ :- ভবভূতির সাহিত্য বৈদগ্ধ্য, পাণ্ডিত্য ও কবিত্বের ত্রিবেনিসংগম। সহজ সরল প্রকাশভঙ্গি সেখানে প্রত্যাশা করা যায় না। সংলাপের বুনোটে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় প্রসঙ্গ যত্রতত্র বিরাজমান। ভাস-কালিদাসের যুগ পেরিয়ে তখন পাঠক-দর্শকের রুচির বদল ঘটেছে, রচনারীতিতে এসেছে কৃত্রিম দীর্ঘ ও জটিল বাক্যবিন্যাস। গদ্যসাহিত্যে বাসবদত্তা, দণ্ডীর দশকুমারচরিত ও বাণভট্টের হর্ষচরিত কাদম্বরী ততদিনে প্রসিদ্ধ নাম। তাদের বাগৈশ্বর্যমণ্ডিত অলংকার-বহুল রচনারীতি থেকে পিছু হঠবার পথ পরবর্তী কবিযশঃপ্রার্থীর পক্ষে সম্ভবত আর খোলা ছিল না।

কালিদাসের পরেই নাট্যকার হিসাবে ভবভূতির নাম আগে মনে আসে। প্রকৃতির রুদ্র ও কমনীয় রূপের বর্ণনায় ভবভূতি সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন। মানুষের মনের গহনে প্রবেশ করে কোমল বৃত্তিগলির সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম রূপ ও রেখার বর্ণনা এমনটি আর কোথাও দেখা যায় না। ভবভূতির সর্বাপেক্ষা বড় ত্রুটি এই যে পাঠকের মনকে তিনি কখনও হালকা রসের বৈচিত্র্যের আস্বাদ দেন নাই। মাঝে মাঝে সমাসবদ্ধ সুদীর্ঘ বাক্যের অবতারণা করেছেন, যার ফলে মন ও চক্ষু হঠাৎ বাধা পায়। কালিদাসের উপমা বস্তুগত—অর্থাৎ একটি বস্তুর সঙ্গে আর একটি বস্তুর তুলনা। ভবভূতির উপমা বস্তু ও ভাবনিষ্ঠ—অর্থাৎ একটি বস্তুর সঙ্গে আর একটি ভাবের তুলনা। এই দিক দিয়ে Shelly-র রচনার সঙ্গে ভবভূতির রচনার অনেকটা সাদৃশ্য আছে। বিশেষ করে উত্তররামচরিতে ঘটনা-বৈচিত্র্যের অভাব বড় বেশী অনুভূত হয়। প্রথম অঙ্কে বর্ণিত ঘটনা হতে দ্বিতীয় অঙ্কে বর্ণিত ঘটনার মধ্যে স্থান ও কালের ব্যবধান খুব বেশী হওয়ায় অসম্ভবতার বোধ জন্মায়। করুণরস-চিত্রণে ভবভূতি নিঃসংশয়ে কালিদাসকে অতিক্রম করেছেন। ভবভূতি অনেক বলতে পারেন, কালিদাস না বলেই বলার কাজ সেরে নেন।

অনুরূপ পাঠ

ভবভূতির উত্তররামচরিত নাটক এর মত একইধরণের বিষয় জানতে নিম্নের LINK এ CLICK করুন ।

উত্তররামচরিত সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য

ভবভূতির উত্তররামচরিত নাটক থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাস্য।

1) উত্তররামচরিত কার লেখা।

মহাকবি ভাসের।

2) উত্তররামচরিত নাটকে কয়টি অংক আছে?

সাতটি।

3) উত্তররামচরিত নাটকের নায়ক কে?

শ্রীরামচন্দ্র।

ধন্যবাদ

আমাদের www.sanskritruprekha.com সাইট Visit করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ🙏। সংস্কৃতের আরো অনেক তথ্য পাওয়ার জন্য Home Page আসুন। Home Page পৌঁছানোর জন্য CLICK HERE👈

আমদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে CLICK HERE 👈

Leave a Comment