নাট্যকার ভবভূতি

এই অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় নাট্যকার ভবভূতি। এখানে নাট্যকার ভবভূতির মূল্যায়ণ কর অথবা ভবভূতি সম্পর্কে টীকা লেখ নিয়ে উপস্থাপন।

সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে ভবভূতি একজন শ্রেষ্ঠ লেখক। সংস্কৃত অনার্স ছাত্র ছাত্রীদের এই অধ্যায় খুঁটিয়ে পড়তে হবে। এছাড়া নাট্যকার ভবভূতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকলে WBSSC ( SLST ) পরীক্ষার্থীদের MCQ নির্ভুলভাবে করা সম্ভব নয়।

নাট্যকারভবভূতি
পিতানীলকন্ঠ
মাতাজাতুকর্ণী
পিতামহভট্টগোপাল
নাটকমালতীমাধব, মহাবীরচরিত এবং উত্তররামচারিত
সময়কাল695 থেকে 750 খ্রিস্টাব্দ

নাট্যকার হিসাবে ভবভূতির স্থান নির্ণয় কর

ভূমিকা :- সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যে কবি কালিদাসের পরেই ‘শ্রীকণ্ঠ-পদ-লাঞ্ছন’ ভবভূতির স্থান। দেহরূপের অন্তরালে মানুষের মনোরাজ্যে শোক ও দুঃখের যে প্রচ্ছন্ন অবস্থা, তাকে অনুভূতির উষ্ণতায় দ্রবীভূত করে নাট্যধারায় উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে ভবভূতি অদ্বিতীয়।

কাল :- ভবভূতি নিজের কথা তাঁর রচনায় কিছু কিছু বলেছেন। কিন্তু নিজের কালের কোনো তথ্য আমাদের দিয়ে যাননি। রাজশেখর সর্ব প্রথম তাঁর বালরামায়ণে ভবভূতির উল্লেখ করেছেন। ভবভূতির রচনাংশ সর্ব প্রথম উদ্ধৃত হয়েছে বামনের কাব্যালঙ্কারে। ভবভূতির উপর কালিদাসের প্রভাব নিঃসংশয়ে পড়েছে। প্রেমকাতর মাধব যখন মালতীর অনুসন্ধানে রত, কিংবা মেঘকে দৌত্যে নিযুক্ত করে মালতীর নিকট প্রেরণ করতে উদ্যত তখন তাতে কালিদাসের পুরুরবা ও যক্ষের প্রভাবই দেখা যায়। কলহণের মতে কনৌজেশ্বর যশোবর্মন, ভবভূতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং ভবভূতি ও বাক্পতি উভয়েই তাঁহার সভাকবি ছিলেন। কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্য কর্তৃক (৬৯৯-৭৩৫ খৃঃ অঃ) যশোবর্মন পরাভূত হন। বাক্পতিরাজ তাঁর গৌড়বহে যশোবর্মনের প্রশংসা করেছেন এবং ভবভূতির নিকট নিজের ঋণ স্বীকার করেছেন। গৌড়বহের রচনাকাল ধরা হয় ৭৩৬ খৃস্টাব্দ। তখনও ললিতাদিত্যের নিকট যশোবর্মনের পরাজয় ঘটেনি। কাজেই খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের শেষভাগ বা অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগ ভবভূতির কাল হিসেবে অধিকাংশ পণ্ডিত স্বীকার করেন।

নাটকত্রয় :- ভবভূতি তিনখানি নাটক রচনা করেন। তাঁর রচিত নাটক গুলি হল –
1) মহাবীরচরিত (বীররস – রামকথাশ্রিত – সাত অঙ্কের নাটক),
2) মালতীমাধব (শৃঙ্গাররস – বৃহৎকথাশ্রিত – দশাঙ্কের প্রকরণ) এবং
3) উত্তররামচরিত (করুণরস – রামকথাশ্রিত – সাত অঙ্কের নাটক)।

কবি পরিচিতি :- দক্ষিণাপথে বিদর্ভ অঞ্চলে পদ্মপুর নগর ভবভূতির পুরুষানুক্রমে বাসস্থান। কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় শাখা তাঁদের বংশানুক্রমিক চর্চার বিষয়। কাশ্যপ গোত্রের এই পণ্ডিত বংশের উপাধি নাম ছিল উদুম্বর। ভবভূতির ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ মহাকবি, পিতামহ ভট্টগোপাল, পিতা নীলকণ্ঠ, মাতা জাতুকর্ণী।

সমালোচনা ও অবজ্ঞা লাভের দুঃসহ যন্ত্রণার স্বীকৃতি ও তাঁর বিরুদ্ধে মহাকালের দরবারে যোগ্য মর্যাদা প্রাপ্তির প্রত্যাশা শ্লোকটিতে (যে নাম কেচিদিহ নঃ প্রথয়ন্ত্যবজ্ঞাং ইত্যাদি) পরিস্ফুট।জীবনের প্রথম পর্যায়ে ভবভূতি নামে নাট্যরচনার পর তিনি পরিণত বয়সে উম্বেক নামে মীমাংসাগ্রন্থ রচনায় হাত দিয়েছিলেন বলে মনে করেন অধ্যাপক কাণে।

যাই হোক, তিনটি নাট্যগ্রন্থেই ভবভূতি তাঁর বংশ পরিচয় ও নিজের বিদ্যাবত্তার কথা লিখে রেখেছেন। মহাবীরচারিত-এ তা বিস্তারিতভাবে থাকায় বোঝা যায়, এটি তাঁর প্রথম রচনা।

তিনটি নাট্যগ্রন্থই কালপ্রিয়নাথের যাত্রা উৎসবে মন্দিরচত্বরে প্রথম অভিনীত হয়েছিল বলে নাট্যকার জানিয়েছেন। অভিনেতৃগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা মালতীমাধব এ সূত্রধারের মুখ দিয়ে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। এই কালপ্রিয়নাথের মন্দিরটি হয়তো নাট্যকারের বাসস্থান পদ্মপুরে অবস্থিত ছিল।

অধ্যাপক মিরাশি কনৌজ থেকে ৭৫ মাইল দূরবর্তী কাল্পি নামক স্থানকে কালপ্রিয় ধরে নিয়ে সেখানকার দেবায়তনে ভবভূতির নাট্যকৃতি অভিনয়ের কথা বলেছেন। রাজতরঙ্গিণী অনুযায়ী কনৌজরাজ যশোবর্মন ভবভূতির পৃষ্ঠপোষক। মালতীমাধব এর প্রস্তাবনায় (১/৬) নিরবধি কাল ও বিপুলা পৃথ্বীতে ভাবীকালে কোনোদিন কোনো সমানধর্মা কবি তাঁর মূল্য বুঝবেন এই ঘোষণা করেছেন তিনি। তাঁর লেখা সম্বন্ধে অবজ্ঞা প্রকাশ করতে অভ্যস্ত সমকালীনদের জন্যে তিনি লিখছেন না একথা বলার পেছনে বাকপতিরাজের ‘গৌড়বহো’ কাব্যে ‘বিকটকথা নিবেশ’ সংক্রান্ত কটু মন্তব্যই কারণ কিনা কে জানে! মালতীমাধব এ ভবভূতি ক্ষুদ্ধ হয়ে দ্বিতীয় রচনার প্রারম্ভে জবাবি মন্তব্য করছেন। উত্তররামচরিত-এ কিন্তু নাট্যকার আর কোনো ক্ষুব্ধ মন্তব্য করেননি। সংক্ষেপে আত্মপরিচয় লিপিবদ্ধ করে নিজের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে দু-একটি মাত্র কথা বলে গ্রন্থনাম ঘোষণা করেছেন। সম্ভবত পরিণত জীবনে উত্তররামচরিত রচনার সময় তাঁর খ্যাতি নিয়ে আর সংশয় ছিল না।

নিজের পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে ভবভূতির প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাস বরাবরই ছিল। একেবারে মহাবীরচরিত-এই তিনি দাবি করেছেন, বাক্দেবী তাঁর বশীভূত— “বশ্যবাচঃ কর্ব্বোক্যং”। উত্তররামচরিতেও তাঁর দাবি—বশীভূত বাগদেবী উত্তররামচরিতকার ব্রাহ্মণ ভবভূতিকে অনুসরণ করেন। এই প্রসঙ্গে নিজেকে ‘পদবাক্য প্রমাণ’ বলতে তিনি ভোলেননি।

উপসংহার :- ভবভূতির সাহিত্য বৈদগ্ধ্য, পাণ্ডিত্য ও কবিত্বের ত্রিবেনিসংগম। সহজ সরল প্রকাশভঙ্গি সেখানে প্রত্যাশা করা যায় না। সংলাপের বুনোটে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় প্রসঙ্গ যত্রতত্র বিরাজমান। ভাস-কালিদাসের যুগ পেরিয়ে তখন পাঠক-দর্শকের রুচির বদল ঘটেছে, রচনারীতিতে এসেছে কৃত্রিম দীর্ঘ ও জটিল বাক্যবিন্যাস। গদ্যসাহিত্যে বাসবদত্তা, দণ্ডীর দশকুমারচরিত ও বাণভট্টের হর্ষচরিত কাদম্বরী ততদিনে প্রসিদ্ধ নাম। তাদের বাগৈশ্বর্যমণ্ডিত অলংকার-বহুল রচনারীতি থেকে পিছু হঠবার পথ পরবর্তী কবিযশঃপ্রার্থীর পক্ষে সম্ভবত আর খোলা ছিল না।

কালিদাসের পরেই নাট্যকার হিসাবে ভবভূতির নাম আগে মনে আসে। প্রকৃতির রুদ্র ও কমনীয় রূপের বর্ণনায় ভবভূতি সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন। মানুষের মনের গহনে প্রবেশ করে কোমল বৃত্তিগলির সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম রূপ ও রেখার বর্ণনা এমনটি আর কোথাও দেখা যায় না। ভবভূতির সর্বাপেক্ষা বড় ত্রুটি এই যে পাঠকের মনকে তিনি কখনও হালকা রসের বৈচিত্র্যের আস্বাদ দেন নাই। মাঝে মাঝে সমাসবদ্ধ সুদীর্ঘ বাক্যের অবতারণা করেছেন, যার ফলে মন ও চক্ষু হঠাৎ বাধা পায়। কালিদাসের উপমা বস্তুগত—অর্থাৎ একটি বস্তুর সঙ্গে আর একটি বস্তুর তুলনা। ভবভূতির উপমা বস্তু ও ভাবনিষ্ঠ—অর্থাৎ একটি বস্তুর সঙ্গে আর একটি ভাবের তুলনা। এই দিক দিয়ে Shelly-র রচনার সঙ্গে ভবভূতির রচনার অনেকটা সাদৃশ্য আছে। বিশেষ করে উত্তররামচরিতে ঘটনা-বৈচিত্র্যের অভাব বড় বেশী অনুভূত হয়। প্রথম অঙ্কে বর্ণিত ঘটনা হতে দ্বিতীয় অঙ্কে বর্ণিত ঘটনার মধ্যে স্থান ও কালের ব্যবধান খুব বেশী হওয়ায় অসম্ভবতার বোধ জন্মায়। করুণরস-চিত্রণে ভবভূতি নিঃসংশয়ে কালিদাসকে অতিক্রম করেছেন। ভবভূতি অনেক বলতে পারেন, কালিদাস না বলেই বলার কাজ সেরে নেন।

ধন্যবাদ

আমাদের www.sanskritruprekha.com সাইট Visit করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সংস্কৃতের আরো অনেক তথ্য পাওয়ার জন্য Home Page আসুন। Home Page পৌঁছানোর জন্য CLICK HERE👈

আমদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে CLICK HERE 👈

Leave a Comment