এই অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় ভাবসম্প্রসারণ। দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ্যসূচীতে ভাবসম্প্রসারণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখানে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যসূচি অনুযায়ী নির্দিষ্ট Suggestive কিছু বাক্যের ভাবসম্প্রসারণ দেওয়া হয়েছে। Amplify। দ্বাদশশ্রেণীর পরীক্ষার্থীদের এই অধ্যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় কখনো কোনো একটি বাক্যে বা শ্লোকের এক বা একাধিক চরণে অনেক অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা, রূপক বা ইঙ্গিত থাকে। সেই ভাবকে বিস্তারিতভাবে লেখা, বিশ্লেষণ করাকে ভাবসম্প্রসারণ বলে। যে ভাবটি শ্লোকের চরণে বা বাক্যে প্রচ্ছন্নভাবে থাকে, তাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করে সর্বসাধারণের বোধগম্য করে তোলাই হল ভাবসম্প্রসারণের উদ্দেশ্য। সাধারণত সমাজ বা মানবজীবনের মহৎ কোনো আদর্শ বা বৈশিষ্ট্য, নীতি-নৈতিকতা, প্রেরণামূলক কোনো বিষয় যে পাঠে বা বাক্যে বা চরণে থাকে, তার ভাবসম্প্রসারণ করা হয়। ভাবসম্প্রসারণের ক্ষেত্রে রূপকের আড়ালে বা প্রতীকের ভেতর দিয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়, তাকে যুক্তি, উপমা, উদাহরণ ইত্যাদির সাহায্যে সেই ভাবনাকে আরও সহজসরল ভাষায় প্রকাশ করতে হয় ছাত্রছাত্রীদের।
নির্দিষ্ট কিছু ভাবসম্প্রসারণ
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে নির্দিষ্ট কিছু ভাবসম্প্রসারণ সহজ ও সরল ভাষায় দেওয়া হল। এই অধ্যায় শুধুমাত্র উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের, তা নয়। অন্যান্য শিক্ষার্থীদের ক্ষত্রেও কাজে আসবে। যাইহোক ভাবসম্প্রসারণ লিখতে গেলে কিছু দিক বিশেষভাবে মাথায় রাখতে হবে। যেমন –
- উদ্ধৃত অংশটি মনোযোগ দিয়ে বার বার পাঠ করে অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝে নিতে হবে।
- অন্তর্নিহিত ভাবটি কোনো উপমা-রূপকের আড়ালে নিহিত আছে কি না, তা চিন্তা করতে হবে।
- সহজ-সরল ভাষায় মূল ভাবটিকে বিবৃত করতে হবে।
- মূল বক্তব্যকে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজনে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করতে হবে।
- একই কথার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- বানান, বাক্যগঠন, বিরাম চিহ্নের ব্যবহার বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
- ভাবসম্প্রসারণটি যেন প্রাসঙ্গিক বিষয় ছেড়ে অন্য বিষয়ের দিকে চলে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ভাবসম্প্রসারণ – “ত্বমসি গতির্মম খলু সংসারে”
গঙ্গাদেবী ভারতবর্ষের প্রানস্বরূপিনী। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে সাগরদ্বীপের কাছে বঙ্গোপসাগরে এসে মিলিত হয়েছে। গঙ্গা শুধুই প্রবহমান এক স্রোত নয়। এই গঙ্গা প্রাণের প্রকাশ ঘটায়। পবিত্র ধারায় মানুষ তার অন্তরের পাপ মুক্ত করে। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা হয়ে ওঠে ধরনী। মানুষ বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পায়। মাতা গঙ্গাদেবীর মহিমা বেদাদিশাস্ত্রেও কীর্ত্তিত হয়েছে- “ইমং মে গঙ্গে যমুনে সরস্বতী “(ঋ 10/75/5)। মাতা গঙ্গাই পরমা গতি। শংকরাচার্য তাঁকে ‘ত্রানকর্ত্রী’ বলে মনে করেছেন। ইহজগতে তাঁকে আশ্রয় করেই মানুষ বেঁচে থাকে। তিনিই সংসার জীবনের পথ দেখাতে পারেন, তাই তিনিই মানুষের গতি অর্থাৎ মুক্তিস্বরূপিনী। তিনি কুবুদ্ধি, শোকতাপ সমস্ত হরণ করে ইহজগতে পরমানন্দ দানে ও জীবনান্তে মুক্তির কান্ডারী হয়ে দেখা দেন। তিনিই ইহ সংসারে ভক্তের একমাত্র পার-তরণী। তারই আশ্রয় চান ভক্ত।
ভাবসম্প্রসারণ – “ন কর্মনামনারম্ভান্নৈষ্কর্ম্যং পুরুষোহশ্নুতে”
এই সংসারে অন্তহীন দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয় মানুষকে। কিন্তু এর থেকে মুক্তির উপায় কী? এ নিয়ে দার্শনিকগণ পথ নির্দেশ করেছেন। সাংখ্য দার্শনিকগণ বলেন, কর্মই মানুষকে বদ্ধ করে। তাই কর্ম ত্যাগ করে কেবল জ্ঞানচর্চা করলে তবেই দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। কিন্তু কর্মযোগীগণ একথা মানতে পারেন না। তাঁরা বলেন, কর্ম ত্যাগ করলে কখনোই নৈষ্কর্ম্য অর্থাৎ ‘কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি’ লাভ করা যায় না। কর্ম দু প্রকার বাহ্যিক কর্ম এবং মানসিক কর্ম। নৈষ্কর্ম্য বলতে কেবল বাহ্যিক কর্ম থেকে যে বন্ধন হয় তার থেকে মুক্তি বোঝায় না, মানসিক কর্ম থেকে যে বন্ধন হয়, তার থেকেও মুক্তি বোঝায়। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হল, বাহ্যিক কর্ম ত্যাগ করলেও মানসিক কর্মকে রুদ্ধ করা যায় না। বাহ্যিক কর্ম থেকে বিরত হয়েও মানুষ মনে মনে বাহ্যবস্তু কামনা করে, তাতে আসক্ত হয়। তাই আসক্তিবর্জিত হয়ে কর্ম করাই কর্মবন্ধন থেকে মুক্তির উপায়। চিত্ত শুদ্ধ হলে কর্ম করলেও মানুষ সেই কর্মের দ্বারা বন্ধ হয় না। তাই অনাসক্ত হয়ে কর্ম করো এটাই দুঃখমুক্তির শ্রেষ্ঠ উপায়।
কর্মেন্দ্রিয়ানি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরন্।
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে।।
মানুষ শাস্ত্রের নিয়মে কাজ করে। শাস্ত্রের নিয়মানুসারে কায়িক আচরণকে সংযত করে। বাহ্য ইন্দ্রিয়কে সংযত করাকেই ঈশ্বর প্রাপ্তির পথ বলে মনে করে। কিন্তু কেবল বাহ্য-আচরণে নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করলেই প্রকৃত সাধনা হয় না। যিনি বাইরে দেখান যে, তিনি কর্মেন্দ্রিয় সংযত করেছেন অথচ মনে মনে উপভোগ্য বস্তুর চিন্তা করতে থাকেন তিনি আর যাই হোন, তাঁর বাহ্যিক আচার আচরণের কোনো ফল হয় না, তিনি ব্যর্থ। আসল মন্ত্র হল আত্মসংযম। বাসনা ও অহংকার ত্যাগই হল প্রকৃত ত্যাগ ও সংযম। যাঁর ভিতরের ত্যাগ আছে, সেখানে বাহ্যিক ত্যাগ বা ইন্দ্রিয় নিগ্রহের কোনই দরকার নেই। সুতরাং ব্যর্থ প্রচেষ্টা ত্যাগ করে আত্মসংযম অবলম্বন করে কাজ করতে হবে।
ততোহয়ং দ্রুততরং ক্রামন্নগরং নিবৃত্তঃ
অলিপর্বা দূর থেকে দেখেছিল ডাকাতদলের কর্মকান্ড। পর্বতের গুহাদেশে সুরক্ষিত সম্পদগুচ্ছ কিভাবে তারা সেখানে রাখে তার গোপন কৌশল শিখে নিয়েছিল চোরদের উচ্চারণের মাধ্যমে। তাই গুহাভ্যন্তর থেকে চোরেরা বেরিয়ে গেলে অলিপর্বা সন্তর্পণে নির্দিষ্ট মন্ত্রোচ্চারণের দ্বারা গুহায় প্রবেশ করল। অতঃপর গুহায় অলিপর্বা সমস্ত দিকে রাশি রাশি ভোজনের সামগ্রী, দামী বস্ত্র, প্রচুর সোনা ও রূপার বাট দেখতে পেল এবং থলে ভর্তি করে তার গাধার ক্ষমতানুসারে সোনা নিল। সোনাভর্তি বস্তাগুলিকে গুহাদ্বারের কাছে এনে নির্দিষ্ট মন্ত্রে গুহামুখ খুলে সেগুলিকে গাধার পিঠে চাপিয়ে কাঠ দিয়ে আচ্ছাদিত করল ও সংবৃতি মন্ত্র দ্বারা গুহামুখ বন্ধ করল। চোরেরা যে কোন সময় সেই গুহাসম্মুখে প্রত্যাবর্তন করতে পারে এই শঙ্কা ছিল। তাই অলিপর্বা কালক্ষেপ না করে দ্রুত সেই সম্পদগুচ্ছ নিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে নগর পৌঁছোল।
অসক্তোহ্যাচরণ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ
ভারতীয় দর্শনশাস্ত্র সংখ্যাতে অনেক। তাদের কর্ম পদ্ধতি ও ভাবনা ভিন্ন ভিন্ন প্রকার। সাধারণ অদ্বৈত বেদান্ত মতে জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। কিন্তু জীবের মধ্যে অজ্ঞানের মায়া ছড়ানো বলে সে নিজেকে পরম বলে জানতে পারে না। আর জ্ঞানমার্গীরা যদিও ‘জ্ঞানাৎ মুক্তিঃ’ বলেন। তথাপি গীতার তত্ত্ব হল আসক্তিহীনভাবে কর্ম করলে তবেই মানুষ সেই কর্মের উর্ধ্বে গমন করে। পরম বস্তুকে লাভ করতে পারে। নতুবা সেই কর্মের ক্ষুদ্র পরিসরেই বদ্ধ থাকে, কর্মের গন্ডি ত্যাগ করে যেতে পারে না। ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে শুধুমাত্র অনাসক্ত হয়ে কর্মফলের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে যদি কর্মানুষ্ঠান করা যায় তাহলে সেই কর্মের ফল পুরুষকে বাঁধে না। অনাসক্তচিত্তে কর্মানুষ্ঠান করলে চিত্তের সমস্ত মালিন্য নষ্ট হয়। এবং সেই নির্মল চিত্তে ব্রহ্মানন্দের আবেশ হয়। তাই কর্মত্যাগ নয়, আসন্তিহীন, ফলাকাঙ্ক্ষা হীন কর্মই মানুষকে মোক্ষমার্গে উপনীত করতে সক্ষম।
দেশঃ পুণ্যতমোদ্দেশঃ কস্যাসৌ ন প্রিয়ো ভবেৎ। যুক্তোহুনুক্রোশসম্পন্নৈর্যো জনৈরিব যোজনৈঃ।
মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায়ে ‘মাৎসন্যায়’-এর উল্লেখ আছে, যেখানে বলা হচ্ছে যে দেশে রাজার সুশাসন নেই, সেই দেশে ‘মাৎসন্যায়‘ নামক বিশৃঙ্খলার উদ্ভব হয়। ধনীদের দ্বারা দরিদ্ররা পীড়িত হয়। রাজ্য ধ্বংস হয়। কিন্তু যে দেশে সুশাসক রাজা থাকেন, প্রজারা ধর্মকর্মে নিরত, যেখানে রাজ্যের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত দয়াদাক্ষিণ্যে পূর্ণ। যেখানে সর্বত্র রাজ্যশাসনের কঠোর-কোমল যুক্তদণ্ডের ঘ্রাণ সুবিস্তৃত, সেদেশ যথার্থই পুণ্যভূমি, সেখানে প্রজারা শান্তিতে বাস করে, এবং তা সকলেরই অত্যন্তপ্রিয় হয়। শ্লেষবাক্যের দ্বারা এরূপ অর্থ হয়, যেখানে উত্তম অর্থাৎ উত্তর প্রান্তে হিমালয়, যেখানে যোজনব্যাপী বাসকারী সম্পদশালী মানুষেরা পুণ্যের অভিলাষী, সেখানে মানুষ শান্তিতে বাস করে, সেই ভূমি বা জনপদ সকল প্রজার একান্ত প্রিয় আর্যাবর্ত ভূমি।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ
প্রাচীনভারতে ধর্ম শব্দ মূলত আচরণ বিধির ক্ষেত্র নিয়ে রচিত হয়েছিল। এজন্যে ধর্মশাস্ত্রগুলি ভারতের একধরনের আচরণবিধি শাস্ত্র। এই আচারমূলক ধর্মের মধ্যে কোনটি স্বধর্ম, কোনটি পরধর্ম তাও শাস্ত্রকাররা নির্দেশ করে গেছেন। যোগ শব্দের অর্থ কর্মের কৌশল- ‘যোগঃ কর্মসু কৌশলম্’-বলেছেন ভগবান। কিন্তু কোনটা করণীয় কর্ম, কোনটি অকর্ম, কোন কর্ম আচরণ করা উচিত- সে প্রসঙ্গে শ্রীকৃয়ের বক্তব্য হল ‘চাতুর্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ’। অর্থাৎ ব্যক্তির গুণ ও যোগ্যতা অনুযায়ী চারটি বর্ণের কর্ম নির্ধারিত। প্রত্যেক বর্ণের জন্যে অনুষ্ঠেয় কর্মের বিধানও শাস্ত্রে নির্দিষ্ট এবং সেই শাস্ত্রনির্দিষ্ট অনুষ্ঠানই স্বধর্ম পালন। যদি নিজস্ব ধর্মাপেক্ষা অন্য বর্ণের বা জাতির কর্ম শ্রেয়তর হয়। তাহলেও তা করা অনুচিত। কেননা অন্যের ধর্ম পালন তার পক্ষে ভয়াবহ অর্থাৎ অকল্যাণকর। এর ফলে সামাজিক স্থিতি ধ্বংস হবে। বর্ণসংস্কারের কলুষতায় সমাজ উচ্ছিন্ন হবে। তাই প্রত্যেকের নিজস্ব বর্ণজাতি অনুসারে ধর্ম পালনই উচিত। অন্যের ধর্মে প্রবিষ্ট হওয়া অত্যন্ত অনুচিত। অন্যায় কর্ম বলে গীতার সিদ্ধান্ত।
ধন্যবাদ
ভাবসম্প্রসারণ তথা আমাদের www.sanskritruprekha.com সাইট Visit করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সংস্কৃতের আরো অনেক তথ্য পাওয়ার জন্য Home Page আসুন। Home Page পৌঁছানোর জন্য CLICK HERE👈
আমদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে CLICK HERE👈