এই অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় আরণ্যক । এখানে আরণ্যক কাকে বলে বা আরণ্যকের লক্ষণ কী, আরণ্যকের অর্থ কী, চার বেদের আরণ্যক নিয়ে আলোচিত বিষয়গুলো স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও স্কুল সার্ভিস কমিশনের WBSSC (SLST) সিলেবাস অনুসারে আলোচিত হল। আরণ্যক জানা থাকলে MCQ এর উত্তরগুলি সহজেই করা সম্ভব।
আরণ্যক হল প্রাচীন ভারতীয় বেদের অংশ যা ধর্মীয় ত্যাগের অর্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলি সাধারণত বেদের পরবর্তী অংশগুলির প্রতিনিধিত্ব করে এবং বৈদিক গ্রন্থের অনেকগুলি স্তরের মধ্যে একটি। বেদের অন্যান্য অংশ হল সংহিতা , ব্রাহ্মণ , এবং উপনিষদ।
বেদ | আরণ্যক |
ঋক্ | ঐতরেয় , কৌষীতকি বা সাংখ্যায়ন |
সাম | ছান্দোগ্য |
যজুঃ | কৃষ্ণযজুর্বেদ তৈত্তিরীয় শুক্ল যজুর্বেদ বৃহদারণ্যক |
অথর্ব | নেই |
আরণ্যক শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ
অরণ্যে অধীতবিদ্যাই আরণ্যকের উপজীব্য। অরণ্যে উক্তমিতি আরণ্যকম্ অর্থাৎ যা অরণ্যে উক্ত হয় তা আরণ্যক। অরণ্য শব্দের একটি অর্থ ব্রহ্ম; অরণ্যের ন্যায় ব্রহ্মা বস্তুটিও গভীর গহন দুষ্প্রবেশ্য। এই দুরধিগম্য ব্রহ্মতত্ত্বের আলোচনার প্রাধান্য হেতু এই জাতীয় রচনাগুলি আরণ্যক নামে অভিহিত। ব্রাহ্মণের দ্বিতীয় অংশ আরণ্যক। যদিও এতে কর্মানুষ্ঠানের বিধান দেওয়া আছে, তথাপি মুখ্যতঃ এটি জ্ঞান ও কর্মের সন্ধিসাধক রূপকবহুল রহস্যবিদ্যা।
আরণ্যকের লক্ষণ
অরণ্যে যে বিদ্যা অধীত বা গৃহীত হয় তাই আরণ্যক। এ প্রসঙ্গে সায়নাচার্যও ঐতরেয় আরণ্যকের ভাষ্যভূমিকায় বলেছেন—
“ঐতরেয় ব্রাহ্মণেদৃপ্তি কাণ্ডমারণ্যকাভিধম্।
অরণ্য এব পাঠ্যত্বাদারণ্যকমিতীর্যতে।।”
মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ এই দুই অংশের সম্মিলিত রূপই বেদ নামে অভিহিত- “মন্ত্র ব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়ম্।” আরণ্যক বেদের এই ব্রাহ্মণভাগের পরিশিষ্ট, আর আরণ্যকের পরিশিষ্টরূপে উপনিষদের নাম করা যায়। বৈদিক সাহিত্যের প্রথম স্তরে মন্ত্র, এখানে দেবদেবীর স্তুতি ও প্রার্থনাই প্রধান, দ্বিতীয়স্তর ব্রাহ্মণ, যাগযজ্ঞই যেখানে প্রধানভাবে আলোচিত এবং তৃতীয় বা শেষস্তরে আরণ্যক ও উপনিষদই মুখ্য। আরণ্যকে কর্মের সাংকেতিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা, উপনিষদে কর্ম হীন বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রকাশ। বৈদিক সাহিত্যির এই তিনটি স্তর। বেদের দুটি কাণ্ড কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। উপনিষদ সম্পূর্ণরূপে জ্ঞানকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত; ব্রাহ্মণে সম্পূর্ণরূপে কর্মকাণ্ডই আলোচ্য, আর আরণ্যক কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ডের মাঝামাঝি স্তরের রচনা। ঋষিগণ অরণ্যের গভীর গহন নির্জনতায় ধ্যাননেত্রে দুরূহ তত্তদর্শন করেছেন। অরণ্য শব্দের একটি অর্থ ব্রহ্ম; অরণ্যের ন্যায় ব্রহ্মা বস্তুটিও গভীর গহন দুষ্প্রবেশ্য। এই দুরধিগম্য ব্রহ্মতত্ত্বের আলোচনার প্রাধান্য হেতু এই জাতীয় রচনাগুলি আরণ্যকনামে অভিহিত। ব্রাহ্মণসাহিত্যে ক্রিয়াবহুল দ্রব্য ও কর্মযজ্ঞের প্রাধান্য, আরণ্যকে ক্রিয়া ও দ্রব্যহীন মানসযজ্ঞই প্রধান। ব্রহ্মচারী বিদ্যার্থী অরণ্যে গুরুর নিকট আরণ্যকবিদ্যা অধ্যয়ন করতেন। গার্হস্থ্য আশ্রম ত্যাগ করে, যাঁরা বানপ্রস্থ অবলম্বন করে বনে যেতেন ব্যয়বহুল যাগযজ্ঞ করার সামর্থ্য তাঁদের থাকত না, তাঁরা আরণ্যাকের এই অধ্যাত্মচর্চ্চা করতেন নির্জনে। প্রাচীন কালে বেদপাঠ ও ব্রতপালন এই দ্বিবিধ কর্ম সম্পন্ন না হলে বিদ্যার্থীর বিদ্যালাভ সম্পূর্ণ হত না। এই বেদব্রতের উপদেশ আছে আরণ্যকে। আরণ্যকে কর্মের বাহ্যাবরণকে ত্যাগ করে, কর্মের আধ্যাত্মিক স্বরূপটি উদ্ঘাটিত হয়েছে। উপনিষদে যে সর্বোচ্চ দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনা আছে তার সূচনা হয়েছে আরণ্যকে।
পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে বেদের যাগযজ্ঞাদি কর্মকাণ্ড ব্রাহ্মণ গ্রন্থের প্রতিপাদ্য এবং অধ্যাত্মবিদ্যা, আত্মতত্ত্ব ব্রহ্মতত্ব, সৃষ্টিরহস্য প্রভৃতি জ্ঞানকাণ্ড আরণ্যক ও উপনিষদের প্রতিপাদ্য। ক্রিয়াকাণ্ডের যাগযজ্ঞের বিবরণাদি আরণ্যক ও উপনিষদে পাওয়া যায় না। দ্রব্যযজ্ঞ আরণ্যকে জ্ঞানযজ্ঞের রূপ নিয়েছে । একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। বাহ্যক্রিয়াকাণ্ডবহুল ‘অগ্নিহোত্র’ যজ্ঞকে ঋগবেদের শাংখ্যায়ন নামক আরণ্যক নিম্নলিখিত রূপে ব্যাখ্যা করেছেন।’ এই আরণ্যকের আর একটি নাম কৌষীতকি আরণ্যক । সম্পূর্ণ দশম অধ্যায়টি বাহ্য অগ্নিহোত্রযাগের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা মাত্র। এই যাগকে ‘আধ্যাত্মিক আস্তর অগ্নিহোত্র’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ‘আধ্যাত্মিকম্ আন্তরম্ অগ্নিহোত্রমিত্যাচক্ষতে’। আহ্বনীয়, গার্হপত্য অগ্নিকুণ্ড দুটি মনুষ্যশরীরাশ্রিত প্রাণ ও অপান বায়ুরূপে ব্যাখ্যাত হয়েছে এবং অগ্নিহোত্রের দুগ্ধ, সমিৎ, আহুতি সম্বন্ধে বলেছেন— ‘শ্রদ্ধাই দুগ্ধ, বাকাই সমিৎ, সত্যই আহুতি এবং প্রজ্ঞাই আত্মা’। এই প্রবচনে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে যে ক্রিয়াবহুল বাহাযজ্ঞ আরণ্যকে লুপ্ত হয়ে জ্ঞানযজ্ঞে আস্তরযাগে রূপান্তরিত হয়েছে, উপাসনা ও জ্ঞানের প্রাধান্য দুন্দুভিত হয়েছে। এই অধ্যাত্মবিদ্যা প্রকৃত অধিকারী ব্যতীত অন্যকে দান করা হত না। শান্ত দান্ত মুমুক্ষু বৈরাগ্যশীল ব্যক্তিকে ব্রহ্মবিদ্ আচার্য এই বিদ্যা দান করতেন। পুরাকালে এতাদৃশ আচার্যগণ বা তত্ত্বদ্রষ্টা ঋষিগণ লোকালয় হতে দূরে বিজন বিপিনে বাস করতেন এবং সেই অরণ্যেই সঙ্গোপনে ব্রহ্মজিজ্ঞাসু শিষ্যকে এই আধ্যাত্মবিদ্যা দান করতেন। তজ্জন্য এই বিদ্যা যে গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে তাকে আরণ্যক বলা হয়। দুই একজন ‘অরণ্য’ শব্দটির ‘ব্রহ্ম’ অর্থ করেছেন। অরণ্য অর্থাৎ যা নিবিড়, গভীর, ব্রহ্মতত্ত্বও অত্যন্ত নিবিড় ও দুরবহগাহ্য। সেই অরণ্য অর্থাৎ ব্রহ্মসম্বন্ধীয় জ্ঞান যে শাস্ত্রে আছে তা আরণ্যক। পূর্বের ব্যাখ্যাটি সর্ববাদিসম্মত। কেউ কেউ আরণ্যককে উপাসনাকাণ্ড ও উপনিষদকে জ্ঞানকাণ্ড বলেছেন।
আরণ্যকের রচনাকাল
বৈদিকসাহিত্যের অন্যান্য স্তরের ন্যায় এই স্তরের আরণ্যকসাহিত্যের সংকলন- কাল নির্ণয় করাও অত্যন্ত দুরূহ। আরণ্যকগুলি প্রধানত ব্রাহ্মণগ্রন্থের পরিশিষ্টরূপে পাওয়া যায়, অধিকাংশ উপনিষদগুলি আরণ্যকের মধ্যেই পাওয়া যায়। অতএব বৈদিকসাহিত্যের এই স্তরের সংকলন বা রচনাকালই আরণ্যক সমূহের সংকলনকাল। আরণ্যকগুলি ব্রাহ্মণ ও উপনিষদের মধ্যবর্তী সেতু।
চার বেদের আরণ্যক
ব্রাহ্মণের যতগুলি শাখা ছিল, আরণ্যকেরও ততগুলিই শাখা ছিল। কিন্তু বর্তমানে যতগুলি ব্রাহ্মণগ্রন্থ পাওয়া যায় ততগুলি আরণ্যকগ্রন্থ পাওয়া যায় না। ঋগ্বেদের আরণ্যক দুটি ঐতরেয় ও কৌষীতকি। ঐতরেয় আরণ্যকে পাঁচটি ভাগ আছে, এদের প্রতিটি ভাগকেই আরণ্যক বলে। দ্বিতীয় আরণ্যকের চার থেকে ছয় অধ্যায় ঐতরেয় উপনিষদ। কৌষীতকি ব্রাহ্মণের শেষভাগ কৌষীতকি আরণ্যক- এতে আছে পনেরোটি অধ্যায়। এর তিন থেকে ছয় অধ্যায় কৌষীতকি উপনিষদ নামে পরিচিত। কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যক মূলত তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের শেষাংশ। তৈত্তিরীয় আরণ্যক দশটি প্রপাঠকে বিভক্ত, ইহার সাত থেকে নয় প্রপাঠকই তৈত্তিরীয় উপনিষদ এবং দশম প্রপাঠকটি মহানারায়ণ উপনিষদ নামে প্রসিদ্ধ। শুল্ক যজুর্বেদের আরণ্যকটির নাম বৃহদারণ্যক। প্রকৃতপক্ষে এটি শুপ্তযজুবেদের শতপথ ব্রাহ্মণের চতুর্দশ বা শেষ খণ্ড। এই খণ্ডের (অষ্টাদশ) শেষ ছয়টি অধ্যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদ। সামবেদের এবং অথর্ববেদের পৃথক কোনো আরণ্যকপাওয়া যায় না। সামবেদের জৈমিনীয় শাখার উপনিষদ ব্রাহ্মণটি আরণ্যকধর্মী এবং তাণ্ড্য বা পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের অংশবিশেষ ছান্দোগ্য আরণ্যক নামে পরিচিত। ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণের শেষাংশ ছান্দোগ্য উপনিষদ। এই উপনিষদে দেবকীনন্দন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম দৃষ্ট হয়।
মূল্যায়ণ
আরণ্যকগুলি চূর্ণকজাতীয় গদ্যভাষায় রচিত। আরণ্যকের গদ্য ব্রাহ্মণসাহিত্যের গদ্যভাষায় মতোই প্রাচীন। ভাষা দুর্বোধ্য না হলেও অনেকসময় সাংকেতিক ভাষায় রহস্যময়ভাব গ্রহণ সহজসাধ্য হয় না। আরণ্যকসাহিত্যেই সর্বপ্রথম ব্যয়বহুল বৈদিক যাগযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সূচনা লক্ষ্য করা যায়। মনে হয় দীর্ঘকালব্যাপী যাগযজ্ঞবহুল ক্রিয়াকর্ম এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ব্রাহ্মণদের মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি করেছিল, তার থেকেই আরণ্যকের ও উপনিষদ সাহিত্যের উৎপত্তি এবং আরো পরবর্তী কালে হিংসাত্মক ব্যয়বহুল যজ্ঞকর্মের বিরুদ্ধে বুদ্ধদেবের জেহাদ ঘোষণা- বৌদ্ধধর্মের সূচনা।
ধন্যবাদ
আমাদের www.sanskritruprekha.com সাইট Visit করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সংস্কৃতের আরো অনেক তথ্য পাওয়ার জন্য Home Page আসুন। Home Page পৌঁছানোর জন্য CLICK HERE👈
আমদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে CLICK HERE 👈
“ঐতরেয় ব্রাহ্মণেদৃপ্তি কাণ্ডমারণ্যকাভিধম্।অরণ্য এব পাঠ্যত্বাদারণ্যকমিতীর্যতে।।”