ব্রাহ্মণ সাহিত্য

এই অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় ব্রাহ্মণ সাহিত্য । এখানে ব্রাহ্মণ কাকে বলে বা ব্রাহ্মণের লক্ষণ কী, ব্রাহ্মণের অর্থ কী, চার বেদের ব্রাহ্মণ সাহিত্য নিয়ে আলোচিত বিষয়গুলো স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও স্কুল সার্ভিস কমিশনের WBSSC (SLST) সিলেবাস অনুসারে আলোচিত হল। ব্রাহ্মণ সাহিত্য জানা থাকলে MCQ এর উত্তরগুলি সহজেই করা সম্ভব।

বৈদিক মন্ত্রসমূহের ব্যাখ্যা এবং যাগযজ্ঞে তাদের প্রয়োগ সম্বলিত গ্রন্থের নামই ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ সাহিত্য হল হিন্দু বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্গত গ্রন্থসমূহ। এই গ্রন্থগুলি বেদের ভাষ্য। ব্রাহ্মণ গ্রন্থাবলির মূল উপজীব্য যজ্ঞের সঠিক অনুষ্ঠান পদ্ধতি। প্রত্যেকটি বেদের নিজস্ব ব্রাহ্মণ আছে। বেদ পরবর্তী যুগের হিন্দু দর্শন, প্রাক্-বেদান্ত সাহিত্য, আইন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যামিতি, ব্যাকরণ, কর্মযোগ, চতুরাশ্রম প্রথা ইত্যাদির বিকাশে ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।

বেদব্রাহ্মণ
ঋক্ঐতরেয় , কৌষীতকি বা সাংখ্যায়ন
সামতাণ্ড্য বা পঞ্চবিংশ, যড়বিংশ, ছান্দোগ্য
যজুঃকৃষ্ণযজুর্বেদ
তৈত্তিরীয়
শুক্ল যজুর্বেদ
শতপথ
অথর্বগোপথ

ব্রাহ্মণ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ

ব্রাহ্মণ শব্দটির বিভিন্ন ব্যুৎপত্তি ও ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেখা যায়। ব্রহ্মন্ শব্দ হতে ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। ব্রহ্মন্ শব্দের অর্থ বেদ মন্ত্র বা বেদ অথবা ব্রাহ্মণ পুরোহিত— অতএব পুরোহিতের যজ্ঞসম্পর্কিত মতামতের আলোচনাই ব্রাহ্মণ। ব্রহ্মন্ শব্দের ব্রাহ্মণরূপ অর্থ সম্বন্ধে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। এ বিষয়ে বহু প্রমাণ আছে। যজুর্বেদের প্রখ্যাত শতপথ ব্রাহ্মণের উক্তি ‘ব্রহ্ম বৈ ব্রাহ্মণঃ’ অর্থাৎ ব্রহ্মন্ই ব্রাহ্মণ।

আচার্য দয়ানন্দ সরস্বতীর মতে— “চতুর্বেদবিদ্ভি ব্রহ্মভিব্রহ্মিণৈর্মহর্ষিভিঃ প্রোক্তানি যানি বেদব্যাখ্যানি তানি ব্রাহ্মণানি।” অথবা ‘ব্রহ্ম বৈ ব্রাহ্মণঃ’ পতঞ্জলির মতেও— ‘সমানার্থাবেতৌ ব্রহ্মন্শব্দো ব্রাহ্মণশব্দ ।’ অতএব ব্রহ্মন্ ও ব্রাহ্মন্ শব্দ একই অর্থ বোঝায়। মীমাংসকাচার্য জৈমিনির মতে ‘মন্ত্রবাহ্মণাত্মক বেদের মন্ত্র ভিন্ন অংশই ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত’ শেষে ব্রাহ্মণশব্দঃ। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের ভাষ্যভূমিকায় সায়নাচার্যও এই অভিমত প্রকাশ করেন। — “মন্ত্রশ্চ ব্রাহ্মণতি দ্বৌ ভাগৌ তেন মন্ত্রতঃ। অন্যদ্ ব্রাহ্মণমিত্যেতদ্ভবেদ্ ব্রাহ্মণ লক্ষণম্।।” অপরপক্ষে মহর্ষি আপস্তম্বের মতে—“কর্মচোদনা ব্রাহ্মণানি।” অর্থাৎ যাগযজ্ঞাদি কর্মের চোদনা বা নির্দেশমূলক শাস্ত্রই ব্রাহ্মণ।

ব্রাহ্মণের ছয়টি বিষয়

কর্মচোদনা পদটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আপস্তম্ব বেদের ব্রাহ্মণভাগে বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর মতে মূলত ছয়টি বিষয় ব্রাহ্মণে আলোচিত হয়েছে। যেমন—

  • (I) বিধি,
  • (II) অর্থবাদ,
  • (III) নিন্দা,
  • (IV) প্রশংসা,
  • (V) পুরাকল্প এবং
  • (VI) পরকৃতি

এই ছয়টি বিষয় ব্যাখ্যা করলে ব্রাহ্মণের আলোচ্য বিষয়গুলি একটি স্বচ্ছ ধারণা জন্মাবে।

বিধি :— বিশেষ বিশেষ কর্মানুষ্ঠানের জন্য যে নির্দেশ, তাই বিধি। নির্দেশসূচক বলেই বিধি বাক্যগুলির ক্রিয়ায় বিধিলিঙ্, লোট্ প্রভৃতির ব্যবহার দেখা যায়। যথা— ‘স্বর্গকামোহশ্বমেধেন যজেত’ অর্থাৎ ‘স্বর্গকামী ব্যক্তি অশ্বমেধ যজ্ঞ করবে । ‘বৃষ্টিকামো কারীর্য্যা যজেত’ অর্থাৎ অনাবৃষ্টি কালে যে বৃষ্টি কামনা করে সে কারীরী যজ্ঞ করবে’ ইত্যাদি প্রবচন বিধি বাক্য।

অর্থবাদ :— অর্থবাদ বেদমন্ত্রের অর্থপ্রসঙ্গে এবং বিবিধ ক্রিয়াকাণ্ড সম্পর্কে ব্রাহ্মণ গ্রন্থে যে সকল ব্যাখ্যা দেখা যায়, তাকে অর্থবাদ বলা হয়। এর মধ্যে দর্শনগত, ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্বনিষ্ঠ আলোচনা আছে। এই সকল অর্থবাদ প্রবচনে পরবর্তী দর্শন, ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্বের বীজ নিহিত হয়েছে।

নিন্দা :— বিরোধী মতের সমালোচনা, খণ্ডন ও পরিহারকে নিন্দা বলে । এতে প্রতিপক্ষদলের মতের নিন্দা ও দোষ দেখান হয়েছে। কোন কোন মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ বিষয়ে, সূক্তনির্বাচন বিষয়ে এবং কতকগুলি হোম বা যজ্ঞের প্রক্রিয়া বিষয়ে তৎকালীন পুরোহিতগণের মধ্যে মতভেদ ছিল। সেটিই স্বাভাবিক। এক ব্রাহ্মণের উক্তি বা নির্দেশ অন্য ব্রাহ্মণে খন্ডিত হয়েছে। এরূপ অনেক দৃষ্টান্ত আছে। “তৎ তথা ন কর্তব্যম্” , “তৎ তথা ন হোতব্যম্” ইত্যাদি।

প্রশংসা :— প্রশংসা অর্থে স্তুতি। ব্রাহ্মণ গ্রন্থে যে সকল বাক্যে যজ্ঞের অনুষ্ঠানবিশেষ প্রকৃত জ্ঞান সহ সম্পাদন করলে ঈন্সিত ফললাভ হয় বলে কথিত হয়েছে সেই সকল প্রবচন প্রশংসার অন্তর্গত।

পুরাকল্প :— অতি প্রাচীনকালে প্রাগৈতিহাসিক যুগে যে সকল যজ্ঞ সম্পাদিত হয়েছিল সেগুলিকে ‘পুরাকল্প’ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। মনুষ্যগণ যজ্ঞ অনুষ্ঠান আরম্ভ করার বহুপূর্বে দেবগণ যজ্ঞ করেছিলেন। আদিপুরুষ বা প্রজাপতি সৃষ্টিসূচনাকালে সর্বপ্রথম যজ্ঞ করেছিলেন এবং সেই প্রথম যজ্ঞ হতে বিরাট চতুর্বেদ, বর্ণচতুষ্টয়, গ্রাম্য ও অন্যান্য পশু, পক্ষী, পঞ্চ মহাভূত, সূর্য, চন্দ্র, অন্তরীক্ষাদি চরাচর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড উৎপন্ন হয়েছিল।

পরকৃতি :— পরের কৃতি বা কার্যকে পরকৃতি বলে। এখানে যজ্ঞে অভিজ্ঞ খ্যাতনামা শ্রোত্রিয় বা পুরোহিতগণের কীর্তি, বিশ্রুত নৃপতিগণের যজ্ঞ, দান, দক্ষিণা ইত্যাদির অলোকসামান্য কীর্তি প্রভৃতি পরকৃতি শব্দে বোঝায়।

ব্রাহ্মণের রচনাকাল

Max Muller-এর মতে ব্রাহ্মণ সাহিত্যের সংকলন কাল 800-600 খৃষ্ট পূর্বাব্দ, অপরপক্ষে Winternitz মনে করেন 2000-1500 খৃষ্টপূর্বাব্দই ব্রাহ্মণসাহিত্যে রচনাকাল। সংহিতা যুগের পরেই ব্রাহ্মণযুগের সূচনা, এর থেকে বেশি নির্দিষ্ট করে ব্রাহ্মণসাহিত্যের রচনাকাল নির্ণয় করা সম্ভব নয়।

চার বেদের ব্রাহ্মণ সাহিত্য

প্রত্যেক বেদের প্রতিটি শাখার একটি করে ব্রাহ্মণ গ্রন্থ ছিল। কালক্রমে বেদের বহুশাখাও বিলুপ্ত হয়েছে, বিলুপ্ত হয়েছে বহু ব্রাহ্মণ গ্রন্থও। ব্রাহ্মণ সাহিত্য একটি বিশাল সাহিত্য-এর অধিকাংশই বর্তমানে বিলুপ্ত। পণ্ডিত বটকৃষ্ণ ঘোষ মহাশয় অনেক বিলুপ্ত ব্রাহ্মণের কিয়দংশ সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছেন।

ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলি প্রধানত গদ্যে রচিত হলেও এর কিয়দংশ গাথাজাতীয় পদ্যে রচিত। ব্রাহ্মণের শেষাংশ আরণ্যক নামে অভিহিত। বৈদিক যজ্ঞের ক্রিয়াপ্রণালী, যজ্ঞবেদির পরিমাপ, যজ্ঞের উপকরণ, পুরোহিতগণের কর্তব্য, যজ্ঞের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্যনির্ণয়, মন্ত্রের ব্যাখ্যা, আখ্যায়িকাদির বর্ণনা ও আনুষঙ্গিক ব্যাকরণের আলোচনা আছে ব্রাহ্মণগ্রন্থে। বিধি, অর্থবাদ ও উপনিষদ এই তিন ভাগে বিভক্ত করা যায় ব্রাহ্মণ সাহিত্যের আলোচ্য বিষয়কে। বিধি অংশে যজ্ঞের নিয়মাবলী, বিধি-বিধান; অর্থবাদ অংশে মন্ত্রের অর্থ ও উদ্দেশ্য বর্ণন, ইতিহাস, আখ্যান ও পুরানের অবতারণা, নারাশংসী জাতীয় গাথা, দেবদেবীর উপাখ্যান, বীরপুরুষগণের কীর্তিকাহিনী; আর উপনিষদ অংশে সৃষ্টিরহস্য, ঈশ্বর ও ব্রহ্মতত্ত্ব এবং দার্শনিক তত্ত্বের তার্কিক আলোচনা।

ঋগ্বেদের ব্রাহ্মণ সাহিত্য

ঋগ্বেদের দুটি ব্রাহ্মণ আছে। যেমন— (1) ঐতরেয় (2) কৌষীতকি বা শাঙ্খায়ন।

ঐতরেয় ব্রাহ্মণ— ঐতরেয় ব্রাহ্মণই প্রধান। এই ব্রাহ্মণের আটটি পঞ্চিকা, প্রতি পঞ্চিকায় পাঁচটি করে মোট চল্লিশটি অধ্যায় আছে। শেষ দশটি অধ্যায় পরবর্তী সংযোজন বলে মনে হয়। এই গ্রন্থে সোমযাগ, অগ্নিষ্টোম, গবাময়ন, দ্বাদশাহ প্রভৃতি যজ্ঞপ্রণালী বিবৃত আছে। ইহার শেষাংশে রাজ্যাভিষেক প্রণালী আছে। ইহার সপ্তম পঞ্চিকার তৃতীয় অধ্যায়ে রাজা হরিশ্চন্দ্রের রোহিতাশ্বের ও শুনঃশেপের কাহিনী আছে, শেষ অধ্যায়গুলিতে আছে পরীক্ষিতের পুত্র জনমেজয়, পিজবনের পুত্র সুদা, মনুর পুত্র শার্যাত ও দুষ্যত্তের পুত্র ভরত প্রভৃতির কাহিনী।

কোষীতকি ব্রাহ্মণ— কোষীতকি ব্রাহ্মণে ত্রিশটি অধ্যায় আছে। এর শেষভাগ কৌষীতকি আরণ্যক।

সাম বেদের ব্রাহ্মণ সাহিত্য

সামবেদের দুটি ব্রাহ্মণ পাওয়া যায়—তাণ্ড্য বা পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ ও তলব্কার বা জৈমিনীয় বা ষড়বিংশ ব্রাহ্মণ। তাণ্ড্যব্রাহ্মণ সোমযাগে পূর্ণ। একে প্রৌঢ় ব্রাহ্মণও বলা হয়। এতে ব্রাত্যস্তোম ও প্রায়শ্চিত্তের বিধান আছে। সায়নাচার্য ব্রাহ্মণের ভাষ্যভূমিকায় সামবেদের আটটি ব্রাহ্মণের নামোল্লেখ করেছেন এবং তাদের ভাষ্যও রচনা করেছেন বলে জানা যায়।

যজুর্বেদের ব্রাহ্মণ সাহিত্য

কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় নামক ব্রাহ্মণ আছে। এটিই যজুর্বেদের শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের তিনটি খণ্ড, প্রতিটি খণ্ড অনেকগুলি প্রপাঠকে বিভক্ত। শুক্ল যজুর্বেদের ব্রাহ্মণ গ্রন্থের নাম শতপথ ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণটি। একশটি অধ্যায়ে বিভক্ত। মাধ্যন্দিনী ও কাণ্ব দুটি শাখা আছে এই ব্রাহ্মণের। মাধ্যন্দিন শাখার শতপথ ব্রাহ্মণ চৌদ্দটি কাণ্ডে একশত অধ্যায়ে বিভক্ত। এর দশ কাণ্ডে অগ্নিচয়ণ বিদ্যা আছে, বারো কাণ্ডে আছে প্রায়শ্চিত্তবিধি, তেরো কাণ্ডে অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা আছে ও দুষ্যস্ত, ভরত, সাত্রাজিত, কাশীরাজ, ধৃতরাষ্ট্র, পরীক্ষিত, জনমেজয় প্রভৃতি রাজার উল্লেখ আছে। দুষ্যন্ত শকুন্তলার কাহিনীও বীজাকারে দৃষ্ট হয়। মৎস্যাবতার ও জলপ্লাবনের কাহিনীও এই ব্রাহ্মণের অন্তর্গত। ব্রাহ্মণসাহিত্যে শতপথ ব্রাহ্মণ সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। এই ব্রাহ্মণের পঞ্চম কাণ্ডটি রাজনৈতিক তথ্যে পূর্ণ। তৎকালীন রাজনৈতিক ইতিহাস জানতে এটি অপরিহার্য গ্রন্থ । এর চতুর্দশ কাণ্ডের কিয়দংশ আরণ্যক ও কিয়দংশ উপনিষদ। এটিই বৃহদারণ্যক উপনিষদ।

অথর্ববেদের ব্রাহ্মণ সাহিত্য

যজ্ঞের সাথে বিশেষ সম্বন্ধ না থাকলেও অথর্ববেদের গোপথ নামে একটি ব্রাহ্মণগ্রন্থ আছে। এতে দুটি কাণ্ড ও এগারোটি প্রপাঠক আছে। প্রথম কাণ্ড যজ্ঞপ্রণালী অনুসারে সংগৃহীত হয়নি, এই অংশটিই মৌলিক ব্রাহ্মণ ভাগ বলে মনে হয়; আর দ্বিতীয় কাণ্ড শতপথ ব্রাহ্মণ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, কৌষীতকি ব্রাহ্মণ ও তৈত্তিরীয় সংহিতা থেকে
গৃহীত।

ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ সাহিত্যের গুরুত্ব

অনেকের ধারণা ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতে কেবল যাগযজ্ঞের কথাই আছে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মধ্যে কেউ কেউ ব্রাহ্মণকে ‘manual of sacrifice ‘ অর্থাৎ যজ্ঞের প্রক্রিয়াপঞ্জী বলেছেন। কেউ কেউ ব্রাহ্মণকে ‘Theological twaddle’ ঈশ্বর ও পরলোক সম্বন্ধে আলোচনা করলে দেখতে পাওয়া যায় কেবল যাগযজ্ঞ বা ক্রিয়াকাণ্ডের কথা নয়, প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি, সভ্যতার বহু তথ্য তাতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। যাগযজ্ঞের বর্ণনা ছাড়াও বৈদিক ভারতের জাতিভেদ, অনুলোম প্রতিলোমাদি বর্ণের কথা, ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের প্রতিযোগিতা, প্রত্যেক বর্ণের জীবিকা ও বৃত্তি, শিক্ষা ও ছাত্রী, ভৌগোলিক পটভূমিকা, বিবাহসংস্কার, স্ত্রীজাতির শিক্ষা ও গুরুত্ব, বাণিজ্য, কৃমি, অর্থনৈতিক অবস্থা, খাদ্য, পানীয়, নৃত্যগীতবাদ্যাদি ললিতকলা, রাজনীতি ও যুদ্ধবিদ্যা, রাজ্যাভিষেকবিধি, বহু প্রকার রাজ্য ও রাজার ক্রমনির্ণয়, সাম্রাজ্য, সার্বভৌম আধিপত্য, তৎকালীন পত্রিকা, ভৈষজ, উদ্ভিদ, পতপক্ষী, স্থাপত্যবিদ্যা, নৌবিদ্যা, অপরাধ ও শান্তি, ভাষাতত্ব, বিবিধ প্রকারের সাহিত্য, শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উৎপত্তি, মৃতদেহ সৎকারবিধি প্রভৃতি বৈদিক আর্যগণের বহুমুখী বৃষ্টি ও সভ্যতার অমূল্য আকর ব্রাহ্মণগ্রন্থরাজি।

মূল্যায়ণ

প্রাচীন ভারতের ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির সম্যক অবগতির জন্য সংহিতা অপেক্ষা ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলি অধিকতর প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছেন পণ্ডিতগণ। ব্রাহ্মণসাহিত্যে দেবতা অপেক্ষা যজ্ঞের প্রাধান্য, যজ্ঞের মাধ্যমে দেবতাকে অভীষ্টপূরণে বাধ্য করা হয়েছে। এখানে দেবতার কোনো স্বাধীনতা নেই, দেবতাও যজ্ঞের অধীন— যজ্ঞই দেবতা হয়ে গেছে। এ যুগে প্রকারান্তরে ব্রাহ্মণেরই প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে।

ব্রাহ্মণসাহিত্যের দুষ্প্রবেশ্য মরুভূমিতে আখ্যান, উপাখ্যান ও গাথাজাতীয় রচনাগুলি মরূদ্যানস্বরূপ। পরবর্তী সংস্কৃতসাহিত্যে এ জাতীয় রচনার প্রভাব অনস্বীকার্য। মহাকাব্য ও পুরাণসাহিত্যে বর্ণিত অনেক উপাখ্যানের বীজ নিহিত আছে ব্রাহ্মণ সাহিত্যে। পুরুরবা উর্বশী উপাখ্যান, হরিশ্চন্দ্র কথা, শুনঃশেপ কথা, প্লাবন কাহিনী ইত্যাদি আরো অসংখ্য কাহিনী ছড়িয়ে আছে ব্রাহ্মণসাহিত্যে। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে ইন্দ্র ভরদ্বাজের উপাখ্যানে ভরদ্বাজের ব্রহ্মচর্য পালনের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। চতুর্থ জন্ম ব্রহ্মচর্য পালন করে ঋষি ভরদ্বাজ ইন্দ্রের নিকটি সাবিত্রীজ্ঞান লাভ করেছেন। যাইহোক ব্রাহ্মণসাহিত্যকে নিছক যজ্ঞীয় অনুষ্ঠান সম্পর্কিত নীরস বিষয়বহুল গ্রন্থ মনে করলে ভুল করা হবে; কর্মের সাথে জ্ঞানকাণ্ডের আলোচনাও সমান মর্যাদা পেয়েছে ব্রাহ্মণ সাহিত্যে পরবর্তী আরণ্যক ও ঔপনিষদিক ভাবধারার পথিকৃৎ বলা যায় ব্রাহ্মণ সাহিত্যকে । বহু দার্শনিক তত্ত্বসমৃদ্ধ ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলি। হরিশ্চন্দ্রপুত্র রোহিতকে উদ্দেশ্য করে ইন্দ্রের মুখে ব্রাহ্মণসাহিত্যেই মানবজীবনের বিখ্যাত চরৈবেতি মন্ত্রের উপদেশ শুনতে পাওয়া যায়—

“আস্তে ভগ আসীনস্যোর্ধ্বস্তিষ্ঠতি তিষ্ঠতঃ।
শেতে নিপদ্য মানস্য চরাতি চরতো ভগঃ চরৈবেতি।।”

যে বসে থাকে তার ভাগ্যও বসে থাকে, উঠে দাঁড়ালে ভাগ্যও উঠে দাঁড়ায়, শুয়ে থাকলে ভাগ্যও শুয়ে থাকে, আর যে চলে তার ভাগ্য চলে, চল, পথ চল। আরো বলা হয়েছে চলমান ব্যক্তিই মধু লাভ করে, চলাই স্বাদুফল। সূর্যের শ্রীকে দেখ, যিনি তাঁর চলার পথে অতন্দ্র। চল, পথ চল।

“চরন্ বৈ মধু বিন্দতি চরন্ স্বাদুমুদুম্বরম্।
সূর্যস্য পশ্য শ্ৰেমাণং যো ন তন্দ্রয়তে চর চরৈবেতি।।”

ধন্যবাদ

আমাদের www.sanskritruprekha.com সাইট Visit করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সংস্কৃতের আরো অনেক তথ্য পাওয়ার জন্য Home Page আসুন। Home Page পৌঁছানোর জন্য CLICK HERE👈

আমদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে CLICK HERE 👈

Leave a Comment